Uncategorized

রমজানে ভেজালের জালে বরিশাল!

  প্রতিনিধি ১১ এপ্রিল ২০২৩ , ১০:২৯:৩৪ প্রিন্ট সংস্করণ

তুফান মাহমুদ ॥  চলছে পবিত্র রমজান মাস। রমজান এলেই যেমন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়, তেমনি খাদ্যপণ্যে ভেজাল মেশাতে তৎপর হয়ে ওঠে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। প্রতি রমজানে বিকাল হলেই পুরো বরিশাল পরিণত হয় ইফতার বাজারে। নানা রঙের, নানা পদের, নানা নামের বাহারি সব ইফতারের পসরা বসে ফুটপাত থেকে শুরু করে নামিদামি রেস্টুরেন্ট ও তারকা হোটেলে। এক ধরনের উৎসবের আমেজ পান বরিশালবাসী। তবে এসব ইফতারের বেশিরভাগ সামগ্রীই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আবার মৌসুম আসার আগেই রমজান মাস এসে পড়ায় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে আম, কাঁঠাল, আনারস, বেল, জামরুল, তরমুজ ও কলাসহ নানা রকম ফল। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন সরকারি কিংবা বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিগত এক দশকের তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, মৌসুমি ফলগুলোর অধিকাংশই পাকানো হয় রাসায়নিক উপাদান দিয়ে। অধিক মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা কাঁচা ফলই ক্ষতিকারক রাসায়নিকের মাধ্যমে পাকিয়ে বাজারে আগাম নিয়ে আসেন। এর ফলে স্বাস্থ্যগত দিক থেকে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ভোক্তারা।

  • ইফতার সামগ্রীতে  কেমিক্যাল ॥   বরিশালেই ছোট-বড় পাঁচ সহস্রাধিক হোটেল-রেস্তোরাঁর পাশাপাশি প্রতি রমজানে আরও প্রায় ২০/২৫ হাজার মৌসুমি ইফতার সামগ্রী বিক্রেতা যোগ হয়েছেন। টার্মিনাল, বাসস্ট্যান্ড, রাস্তা-ফুটপাথ, অলিগলি সর্বত্রই চলছে ইফতারি বিক্রির ধুম। একই সঙ্গে চলছে অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে ভেজাল খাদ্যসামগ্রী বিক্রি। ইফতারি পণ্যে ক্ষতিকারক রং, ফরমালিন, পোড়া মবিল, পোড়া তেল, ইউরিয়া সার, কার্বাইড প্রভৃতি ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ, জিলাপি, কাবাব ও মুখরোচক বিভিন্ন খাবারে খাবার রঙের পরিবর্তে কাপড়ের রং ব্যবহার হচ্ছে হামেশাই। কাপড়ের রঙের চেয়ে খাবার রঙের দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় অসাধু ব্যবসায়ীরা ক্ষতিকর টেক্সটাইল রং ব্যবহার করছে। যা মানবদেহের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। বাজার পরিদর্শকরা বলেন, দোকানে বা ফুটপাথে যে ইফতারি বিক্রি হয় তার প্রায় ৯০ ভাগই ভেজাল। ভেজালের পাশাপাশি রয়েছে বাসি বা পুরনো খাবার বিক্রির প্রবণতা।
  • তরমুজে বিপজ্জনক রং ॥  গ্রীষ্মের রসালো ফল তরমুজ। সুস্বাদু এ ফলটি গরমে কাহিল মানুষের যেমন তৃষ্ণা মেটায় তেমনি আনে স্বস্তি। শহরবাসী অথবা গ্রামের মানুষ সবাই কমবেশি তরমুজ খেতে পছন্দ করেন। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পানি। তরমুজে শতকরা ৬ ভাগ চিনি এবং ৯২ ভাগ পানিসহ অন্যান্য ভিটামিন জাতীয় উপকরণ রয়েছে। ফলটির পুষ্টিগুণ যেমন তেমনি দেশি ফলের ভেতরে দামও তুলনামূলক কম থাকায় গরমে স্বস্তি দিতে তরমুজের জুড়ি নেই। তরমুজের মতো সহজলভ্য ফলেও এখন মেশানো হচ্ছে ক্ষতিকারক উপাদান। তরমুজকে পাকা এবং লাল দেখানোর জন্য মেশানো হচ্ছে বিপজ্জনক লাল রং ও মিষ্টি স্যাকারিন। ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমে তরমুজের বোঁটা দিয়ে এসব দ্রব্য পুশ করে তরমুজ লাল টকটকে ও সুমিষ্ট বলে বিক্রি হচ্ছে। ক্ষতিকারক দ্রব্য মেশান এ ধরনের তরমুজ খেয়ে সারা দেশে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ অসুস্থ হওয়ার বেশ কিছু ঘটনা সম্প্রতি খবরে এসেছে। শহরের ফলের আড়ৎগুলোতে ব্যবহৃত পুরনো ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমে ভোরবেলায় বিষাক্ত লাল রং ও মিষ্টি স্যাকারিন পানি পুশ করা হচ্ছে। আর এ তরমুজগুলোই দোকানে ছুরি দিয়ে কেটে পাকা দেখিয়ে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন গবেষক জানান, রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বিষাক্ত রং। ইফতারির বেশিরভাগ আইটেমেই নানা ধরনের রং মিশিয়ে মানুষের কাছে আকর্ষণীয় ও লোভনীয় করে তোলা হয়। এছাড়া যত রকম গুঁড়া আইটেম আছে সেগুলোতেও সহজে ভেজাল মেশানোর সুযোগ থাকে। মিষ্টি ও তৈলাক্ত আইটেমেও ভেজালের প্রবণতা দেখা যায়।
  • কলায় স্তরে স্তরে বিষ ॥ কলা নয় যেন বিষের দলা। সেটাই খাচ্ছি প্রতিদিন। কলার কাঁদি কাটা থেকে আরম্ভ করে বাজারজাত করা পর্যন্ত স্তরে স্তরে দেয়া হয় তরল বিষ। দেখতে সুন্দর এবং হলুদ রঙের কলাগুলোই বাজার থেকে কিনে খাচ্ছেন সবাই। মাঠ পর্যায়ে কলা চাষীদের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, কাঁদি কাটার আগ পর্যন্ত ভাইরাস তাড়ানোর নাম করে স্প্রের মাধ্যমে ছড়ানো হচ্ছে নানা কীটনাশক। এরপর কলাগুলো রাজধানীতে প্রবেশের আগে পাইকাররা আরেক দফায় স্প্রের মাধ্যমে নানা ধরনের কীটনাশক মেশান। চাষীরা জানান, তারা স্প্রের মাধ্যমে মার্শাল, হিলডন, রাইজার, বাসুডিনসহ আরও অনেক ধরনের ওষুধ ছিটান কাঁচা কলায়। কলার পাইকার ও কৃষক দাবি করেন, এসব মাখালে কোনো ক্ষতি হয় কিনা তারা জানেন না। তবে স্প্রে করলে কলা দ্রুত পেকে যায়। এছাড়া বিভিন্ন মেডিসিন মিশ্রিত পানিতে কলার পানা ডুবিয়ে পরে জাগ দিয়েও পাকান হচ্ছে মানব দেহে আয়রনের ঘাটতি পূরণে অতি প্রয়োজনীয় ফলটি। কলাগুলো সুন্দর আর স্পটমুক্ত করতেও ব্যবহার করা হয় নানা ধরনের রাসায়নিক। ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক বলেন, ফলগুলো না পাকা অবস্থাতেই গাছ থেকে পেরে এনে অসাধু ব্যবসায়ীরা ইথিলিন, রাইপেন, ক্যালসিয়াম কার্বনেট দিচ্ছে। এই ফলগুলো খাওয়ার ফলে পাকস্থলীতে এসিডের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। পাকস্থলীতে যদি কোনো ক্ষত থাকে সেটি আরও বেড়ে যায়। সেখান থেকে ক্যান্সারও হতে পারে। ক্যাব সভাপতি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভোক্তারা খুবই অসহায়। সাধারণ ভোক্তার অসহায়ত্ব দূর করতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, আইন এবং শাস্তি আরও ব্যাপক জনমুখী, গণমুখী হওয়া দরকার। একই সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা, মাঠ পর্যায়ের জরিপ, বাস্তব অবস্থা, ভোক্তার স্বার্থবিনাশী সন্দেহভাজন ব্যক্তি বা সম্ভাব্য প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ থাকতে হবে। তবে ভোক্তার স্বার্থরক্ষার গুরুদায়িত্বটি সরকারের হাতে। শুধু নিয়ম রক্ষার কাজ করলেই হবে না। কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত রাখতে হবে।
  • কাপড়ের রং দিয়ে ঈদের সেমাই ॥
    সারা বছর বাজারে যে পরিমাণ সেমাই বিক্রি হয় তার প্রায় ৯০ শতাংশই হয় ঈদের মৌসুমে। চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে প্রতি বছরই ঈদ সামনে রেখে দেশজুড়ে সেমাই তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। চলে নকল ভেজাল সেমাই তৈরির কসরত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নোংরা স্যাঁতসেঁতে মেঝের মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে ময়দা। সে ময়দায় পানি দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে মণ্ড তৈরি করে শ্রমিকরা। মেঝেতে রাখা মণ্ডে পড়ে থাকে মাছি ও বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড়। এভাবে মণ্ড বা খামির মেশিনে দিয়ে বানানো হচ্ছে চিকন ও লাচ্ছা সেমাই। সেমাইতে মেশানো হচ্ছে কৃত্রিম রং। মেশিনে সেমাই কাটা শেষে খোলা উঠানের মধ্যে ফেলে রাখা হচ্ছে। এভাবে খোলা আকাশের নিচে রাস্তার ধারে রোদে শুকানো হচ্ছে সেমাই। সেমাই শুকালে নিয়ে আসা হয় ভাজার জন্য। সবশেষে অসাধু ভেজাল ব্যবসায়ীরা চকচকে মোড়কে মুড়িয়ে বিএসটিআই’র ভুয়া সিল লাগিয়ে নকল-ভেজাল সেমাই তুলে দেয় মানুষের হাতে। বরিশালে অধিক মুনাফার লোভে নিমানের উপকরণ ব্যবহার করে আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে সেমাই তৈরির ধুম পড়েছে।
  • শীতল পানীয়তে অস্বাস্থ্যকর উপকরণ ॥
    তীব্র তাপদাহ আর ১৫ ঘণ্টার রোজা রেখে তৃষ্ণায় হাসফাঁস করতে থাকেন সবাই। তখন ইফতারিতে অনেকটা স্বস্তি দিতে পারে ঠাণ্ডাপানীয় কিংবা যে কোনো ফলের জুস। তবে রাস্তার পাশে গড়ে ওঠা খোলা শরবতের দোকানের শরবত কতটা স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। পথচারী রোজাদারদের অনেকেই ফুটপাতে তৈরি নিম্নমানের শরবত পান করেন, আর তখনই হয় বিপত্তি। যা থেকে হতে পারে যে কোনো পানিবাহিত রোগসহ কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস ও জণ্ডিসের মতো মারাত্মক রোগ। অভিযোগ আছে- এসব জুস, শরবত কিংবা বরফ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে সাপ্লাই কিংবা পাবলিক টয়লেটের পানি। মিষ্টি করতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিষাক্ত ঘনচিনি। মেশানো হচ্ছে সেকারিন। সরেজমিন দেখা গেছে, যেসব ফিল্টারে পানি রাখা হচ্ছে তার অধিকাংশই অরক্ষিত। হাত ধুতে যে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে তাও দীর্ঘসময় পরিবর্তন করা হয় না। মানুষ পানীয় খেয়ে যেসব বোতল রাস্তায় ফেলে দেয়, টোকাইরা সেসব সংগ্রহ করে অল্প টাকার বিনিময়ে শরবতওয়ালের কাছে বিক্রি করে। সেই বোতলেই পরে শরবত ভরে পার্সেল করা হয়। প্রায় প্রতি দোকানেই দেখা যায় কিছু বোতল ঝোলানো, আর সেসব বোতলের নিচে পানি বা উচ্ছিষ্ট কোক তলানি হিসেবে থেকে যায়। চিকিৎসকরা বলছেন, রাস্তার পাশ থেকে কেনা পানীয় খেয়ে হতে পারে মারাত্মক ব্যাধি। এসব পানীয় ডায়রিয়া, পেট ব্যথাসহ পানিবাহিত যে কোনো রোগের কারণ হতে পারে। এছাড়াও এসিডিটি, হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘বি’সহ ডিসেন্ট্রি হতে পারে। আশঙ্কা থাকে ফুড পয়োজনিংয়েরও।
  • ফলে মাছি বসাতেও কেমিক্যাল ॥
    ফলের মধ্যে ফরমালিন মেশানো হলে তার ওপর মাছি বা এ ধরনের পোকা বসে না। এতে ফল কেনার ক্ষেত্রে অনেক ক্রেতাই সতর্ক হয়ে যান। তাই সচেতন ক্রেতাদের ফাঁকি দিতে ব্যবসায়ীরা নিয়েছেন নতুন কৌশল। মাছি আকর্ষণ করতে তারা এখন মেশাচ্ছে নতুন আরেক ধরনের বিষাক্ত কেমিক্যাল। এর ফলে একদিকে যেমন প্রতারিত হচ্ছেন ক্রেতারা, অন্যদিকে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। বরিশালের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ফলের ওপর আগে মাছি ভনভন করত। এখন আর সেগুলোর আশপাশে কোনো মাছি বসতে দেখি না। শুনেছি কেমিক্যালের গন্ধে ফলের ওপর মাছি বসে না। তাই যেসব ফলের ওপর মাছি বসছে, সেগুলো বেছে বেছে কিনছি। তবে শুনছি নতুন আরেক ধরনের কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে যাতে ফলের ওপর পোকা বসে। এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

আরও খবর

Sponsered content