প্রতিনিধি ১২ জুলাই ২০২০ , ৮:৫৯:৪৬ প্রিন্ট সংস্করণ
তালাশ ডেস্ক ॥ দারিদ্রতা ঘুচাতে বন্ধুকে জবাই করে লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয় খালে। ছিনতাই করা হয় ব্যাটারী চালিত অটো গাড়ি। পুরো হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয় স্ত্রী ও শ্বাশুড়ির সামনে। তারপর ঠান্ডা মাথায় শ্বশুর বাড়িতে ফিরে স্বাভাবিকভাবেই জীবন-যাপন করছিলেন। বন্ধুর সেই অটো গাড়িটি দিয়ে রোজগার শুরু করেও দেন ঘাতক। কিন্তু অটো গাড়িটি শনাক্ত হওয়ায় ফাঁস হয়ে যায় নৃশংস সেই ঘটনা।
নিহতের স্বজনদের চেষ্টায় অটো গাড়িটি উদ্ধার ও সন্দেহভাজন দুজনকে আটকের পর রিমান্ডে নিলে বেড়িয়ে আসতে শুরু করে চাঞ্চল্যসৃষ্টিকারী হত্যাকান্ডের কারণ। মূলত করোনার প্রার্দুভাবে সৃষ্ট অভাব থেকে বাঁচতে তিনমাস ধরে হত্যাকান্ডের সিদ্ধান্ত নেয় ঘাতক দম্পতি। পরিকল্পনার বাস্তবায়নও করেছে ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে জবাই করে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তাদের।
বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানার এসআই আল আমিন জানিয়েছেন, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২৪ নং ওয়ার্ড সাগরদী এলাকার ধান গবেষণা সড়কের কুদ্দুস মিয়ার বাসার ভাড়াটিয়া সুমি বেগমের দাখিল করা একটি সাধারণ ডায়েরীর সূত্র ধরে কাজ শুরু করেন তিনি। এরপরে অটো মালিক রিফাতের দায়ের করা মামলায় যার কাছ থেকে অটোটি উদ্ধার করা হয়েছে তাকে ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে আটককৃতরা স্বীকার করেন তারা কিভাবে ঠান্ডামাথায় হত্যাকান্ডটি ঘটিয়েছেন।
জানা গেছে, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২৪ নং ওয়ার্ড সাগরদী এলাকার ধান গবেষণা সড়কের কুদ্দুস মিয়ার বাসার ভাড়াটিয়া সুমি বেগমের সাথেই থাকতেন তার বোনের ছেলে রুমান (২২)। রুমানের মা-বাবা বেচে না থাকায় ছোট বেলা থেকেই সুমি বেগমের সাথে বড় হয়েছেন। পেশায় রুমান একজন অটো চালক।
সুমি জানিয়েছেন, অন্যান্য দিনের মত সোমবার (২৯ জুন) রাত ১০টার দিকে মোবাইলে রুমান জানায় সে একটি বড় ট্রিপ পেয়েছে। বাকেরগঞ্জ যাবে। আমি নিষেধ করেছিলাম। অতরাতে অতদূর না যাওয়ার জন্য। কিন্তু রুমান জানায়, সমস্যা নাই। তার বন্ধু, পরিচিত আসলামের সাথে যাবে। আসলাম তার স্ত্রী ও শ্বাশুরি নিয়ে কাংকি যাবেন। ভাড়াও দিবে বেশি।
জানা গেছে, আসলামও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২৪ নং ওয়ার্ড সাগরদী এলাকার ধান গবেষণা সড়কে বসবাস করেন। ২৯ জুন রাত ১০টায় সাগরদী থেকে বাকেরগঞ্জ উপজেলার ৪ নং দুধল ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ড চাটরার উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যান। ওইরাত ৩টার দিকে সুমি আক্তারের সাথে একবার মুঠোফোনে কথাও হয় রুমানের। কিন্তু তারপর তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। আর ফিরেও আসেনি রুমান। বোনের ছেলেকে খুঁজে না পাওয়ায় ৩০ জুন বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেন সুমি বেগম।
এর কিছুদিন পরে রুমানের ভাড়ায় চালানো অটোটির সন্ধান পায় স্বজনরা। সুমি জানায়, অটো নিয়ে বাকেরগঞ্জের দুধল ইউনিয়নের আটরা গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে বসবাস শুরু করে দেন আসলাম। সেখানে অটো চালিয়ে রোজগারও শুরু করেন। তবে সন্ধান পেয়ে কোতয়ালী পুলিশ সাথে নিয়ে ৯ জুলাই বিকেলে অটোটি উদ্ধার করে নিখোঁজ রুমানের স্বজনরা। আটক করা হয় আসলাম ও তার স্ত্রী খাদিজাকে। ওইদিনই অটোর মালিক রিফাতের দায়ের করা মামলায় আসলাম ও খাদিজাকে গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ।
দুইদিনের রিমান্ডে আসলাম স্বীকার করেন, অভাবের তাড়নায় তিন মাস আগেই পরিকল্পনা করেন প্রয়োজনে মার্ডার করে হলেও দারিদ্রতা ঘুচাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী রুমানকে নিয়ে বাকেরগঞ্জ শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। রাত আনুমানিক ৩টার পরে দুধল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোর্শেদ খান উজ্জলের বাড়ির পাশে অটোটি থামাতে বলেন। অটোতে তার স্ত্রী খাদিজা বেগম, শ্বাশুরী সহিদা বেগম ছিলেন। অটো গাড়িটি রুমান থামালে ‘পান খাওয়ার’ জন্য নিকটস্থ রাঙ্গামাটি নদীর পাড়ে নিয়ে যান।
সেখানে নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রুমানকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে কোমরে গুঁজে রাখা ধারালো চাকু দিয়ে চেপে ধরে একাই জবাই করে আসলাম। তারপর লাশটি নদীতে ফেলে দেয়। কিন্তু দেখে লাশটি ভেসে উঠেছে। শেষে নদীতে নেমে পেট চিরে ভাসিয়ে দেয়। ফজরের আজানের দিকে অটোর কাছে ফিরে আসে আসলাম। এসে জানায় তিনি রুমানকে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছে। তারপর অটোটি নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে চলে যায় সে।
পুলিশ বলছে, একা হত্যাকান্ড সংঘটিত করতে পারে না। এতে অন্যান্যরাও সহায়তা করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি জানতে সকল তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তবে আটকের পর পুলিশকে গল্প শুনিয়েছিল অভিযুক্ত আসলাম দম্পতি। আসলাম দাবী করেছিল, একলাখ ২৫ হাজার টাকায় রুমানের কাছ থেকে অটোটি ক্রয় করে রাখেন সে। দপদপিয়া জিরো পয়েন্টে বসে ওইরাতে টাকা দিয়ে দেন তিনি। মূলত, সেকেন্ড হ্যান্ড অটো ক্রয় করতে এত টাকা দরকার হয় না। সাধারণত ৫০/৬০ হাজার টাকায় সেকেন্ড হ্যান্ড অটো পাওয়া যায়।
কিন্তু সেকেন্ড হ্যান্ড অটো চড়া মূল্য দিয়ে কিনবে কেন আসলাম-এমন সন্দেহ থেকেই ঘটনাটি হত্যাকান্ড বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করে পুলিশ। আর তারপরতো একে একে ফাঁস হতে থাকে রহস্য।
কোতয়ালী থানার ওসি নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ ঘটনায় নতুন করে হত্যা মামলা দায়ের করা হবে। মামলার প্রস্তুতি চলছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আল আমিন জানিয়েছেন, নিহত রুমানের লাশ এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। লাশ উদ্ধারে অভিযান চলছে।