প্রতিনিধি ২৯ জুন ২০২১ , ১১:৩৮:৪০ প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইজুল মুন্না ॥ কথায় আছে, মানুষের দেহ থেকে প্রাণ গেলে আর কিছু থাকেনা। সেই লাশের সাথে এবার অমানবিক ঘটনা ঘটালেন বরিশালের মীরগঞ্জ খেয়াঘাটের কর্তাবাবুরা। জানা যায়, মুলাদী উপজেলার ৯নং ওয়ার্ড নিবাসী তপন সরদারের মা চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তার লাশ ঢাকা থেকে গত ২৪ শে জুন বৃহস্পতিবার মুলাদীর উদ্দেশ্যে লাশবাহী এম্বুলেন্সযোগে নিয়ে আসেন পরিবারের সদস্যরা। এম্বুলেন্সটি মীরগঞ্জ ঘাটে আসলে শুরু হয় তুলকালাম কান্ড! ফেরীতে এম্বুলেন্স পারাপারে বাঁধা দেয় ঘাটের কর্তাবাবুরা। তাদের দাবী লাশবাহী এম্বুলেন্স পার হতে ৫ হাজার টাকা প্রয়োজন।
মৃত ওই নারীর স্বজন রিপন অভিযোগ করে বলেন,‘মীরগঞ্জ খেয়াঘাটে মানুষের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করে আগে শুনেছি কিন্তু একটা লাশের গাড়ি আটকে রেখে টাকা দাবী করবে এটা ভাবতেও পারিনি। লাশ নিয়ে মীরগঞ্জ ঘাটে গেলে তারা এম্বুলেন্স পারাপারের জন্য ৫ হাজার টাকা দাবী করেন। আমাদের কাছে ১৫শ’ টাকার বেশি ছিলোনা, আমরা অনেক আকুতি-মিনতি করে ১৫শ’ টাকা রাখার কথা বললেও তারা সাফ জানিয়ে দেয় যে ৫হাজার টাকার এক টাকাও কম হবে না। পরে আমরা লাশ এম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে আমাদের এক পরিচিত জনের ট্রলারে করে ওপার নেই।’
খেয়াঘাটে দীর্ঘদিনের জিম্মিদশায় থেকে পরিত্রাণ মিলছে না মুলাদীবাসীর। যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ও হয়রানির অভিযোগ পাহাড় সমান অবস্থানে চলে আসলেও স্থানীয় প্রভাব ও আধিপত্যের কাছে তা সব হার মেনে যাচ্ছে। যদিও এই ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের নিশ্চুপ থাকার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে স্থানীয় সচেতন মহলের মনে জায়গা পেয়েছে চাপা ক্ষোভ। এলাকাবাসী ও যাত্রীদের এমন অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নামে দৈনিক আজকের তালাশ। সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে দেখা যায় এর বাস্তব প্রমাণ চিত্র। পাঠকদের সুবিধার্থে তুলে ধরা হলো অনুসন্ধানের প্রতিটি মূহুর্ত। বরিশাল থেকে যাত্রা শুরু করে মীরগঞ্জ খেয়াঘাট এলাকায় উপস্থিত হয় দৈনিক আজকের তালাশ।
স্থানীয়দের সাথে আলাপ হলে জানা যায়, হিজলা-মুলাদী এলাকার একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম এই খেয়াঘাটে ইজারাকৃত ট্রলার রয়েছে দুইটি (যা কিনা লাল নিশান টানিয়ে নির্ধারণ করা রয়েছে)। নদী পারাপারে সময় লাগে (এপার-ওপার) প্রায় ২০ মিনিটের মতো। সেমতে নির্ধারিত ইজারার ট্রলার ঘাটের দুই প্রান্তে অবস্থান করার কথা। দীর্ঘক্ষণ ঘাটে ইজারার কোন ট্রলারের কোন খোঁজ না পাওয়া গেলে পরে উপায়ন্তর হয়ে একটি ট্রলারে নদী পারাপারের জন্য ট্রলারে ওঠে অনুসন্ধানী দল। মাঝ নদীতে ১২/১৩ বছরের একটি শিশু ভাড়া নিতে অগ্রসর হয়। মটরসাইকেল বাবদ ৪০ টাকা এবং জনপ্রতি ১০ টাকা করে সর্বমোট নেয়া হয় ৫০ টাকা। খেয়ার নির্ধারিত টাকা দিয়ে পার হতেই হঠাৎ পথরোধ করে একজন লোক।
৪০ টাকা দেন? এমন আবদার ছুড়ে দেয়। অনুসন্ধানী দলের প্রশ্ন কিসের টাকা? প্রতিত্তোর আসে , “কিসের টাকা জানেন না, ঘাডের টাকা”। কোন রশিদ বিহীন টাকা পরিশোধ করে আমরা এগিয়ে গেলাম কিছুদূর। চায়ের দোকানে অপেক্ষা করতে লাগলাম যাত্রীদের। কিছুক্ষন পরে কথা হয় ৭০ বছরের এক বৃদ্ধ মন্নান মিয়ার সাথে । প্রশ্ন করলাম দুইবার কিসের টাকা । তিনি জানান- বাবা এটা সুমন রাঢ়ীর। তার যেমনি মন চায় তেমনি চলে এ ঘাট। ইউএনও কিছু বলেনা। কে এই সুমন রাঢ়ি ? খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুমন রাঢ়ীর পরিচয়। তিনি মুলাদী প্রেসক্লাবের সভাপতি। গত ১০ বসর প্রেসক্লাব তার দখলে।
কথা হয় ইসমাঈল সাহেবের সাথে। তিনি এই এলাকার বাসিন্দা।
তার দেয়া তথ্যমতে জানা যায়, ইজারাদার সুমন রাঢ়ির নিয়োজিত একটি মহল ব্যস্ত থাকেন টোল আদায়ের কাজে। নিয়ম অনুযায়ী শুধুমাত্র ইজারাদারের ট্রলারে যাত্রি পারাপার করার কথা। কিন্তু ২ টি ট্রলার রয়েছে বাকিগুলো তাদের ইচ্ছে মতো ব্যক্তি মালিকানাধিন । রিজাভের নামে ২ বার ভাড়া আদায় করা হয়। এই পথে প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষের যাতায়ত করে বলে দাবি করেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে মুলাদীর একজন শিক্ষক। তিনি জানান এর প্রতিবাদ করতে গেলে তাকে হতে হয় লাঞ্চিত। গতমাসে ভুক্তভোগীদের এই অবস্থা থেকে মুলাদী পুলিশ বেশ কয়েকদিন ঘাট পরিদর্শন করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাদের চোখে এমন ঘটনা অপরাধ বলে মনে হয়নি বলে টিমকে জানান তিনি। স্থানীয় বেশ কিছু বিশ্বস্ত সূত্রের দেয়া তথ্য, অভিযোগ ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে রয়েছে এর অন্তরালের খবর।