প্রতিনিধি ২১ ডিসেম্বর ২০২২ , ১:০২:১৪ প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইজুল ইসলাম: বরিশালে সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে চলছে ইট ভাটা। অধিকাংশ ভাটা পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে ও ফসলি জমিতে স্থাপন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। পাশাপাশি ব্যবহার করা হচ্ছে ছোট ব্যারেলের (টিনের) চিমনি। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও প্রতিবেশ। আইন অমান্য করে দিনের পর দিন ইট ভাটার সংখ্যা বাড়লেও প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এদিকে, ভাটায় উন্নত প্রযুক্তির জিগজ্যাগ কিলন, ভার্টিক্যাল স্যাফট ব্রিককিলন, হাইব্রিড হফম্যান কিলন ও টানেল কিলন ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও অধিকাংশ ভাটাতেই ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ ব্যারেল চিমনি।
জানাজায় বরিশাল সদর উপজেলার চরকাউয়ার রুবেল গাজীর সিকো ব্রিকস,আরিফ ব্রিকস, নুর হোসেনের ফুজি ব্রিকস, দূর্গাপুরে ইসলাম হাওলাদারের আরাফাত ব্রিকস, চরবাড়ীয়ার রশিদ ও নুরের ইসলাম ব্রিকস, ফারুক মৃধার হাসান ব্রিকস, মো: ইউনুসের ইনা ব্রিকস, সিরাজুল ইসলামের মিনা ব্রিকস, বাকেরগঞ্জের গারুলিয়ার সুলতান মাহমুদের সুরমা ব্রিকস (অবৈধ ড্রাম চিমনি), কলশকাঠীর বারেক ও খালেক আকনের রুপা ব্রিকস ১-২ ও ৩, রয়েল দাসের রয়েল ব্রিকস, দেলোয়ার হোসেন নজরুলের গাজী ব্রিকস (অবৈধ ড্রাম চিমনি), গঙ্গা ব্রিকস, বি বি এ টি এ ব্রিকস, এস বি এ টি এ ব্রিকস, সমসের হাওলাদারের রাজা ব্রিকস ওয়ান, চরামদ্দিতে চুন্নু সিকদারের ছুবা ব্রিকস, পেয়ারপুরের কাজী মাহফুজের কাজী ব্রিকস সহ বিভাগে আরো ৬০০টি ইটভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
সরজমিনে ইট ভাটাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ইট ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। ফলে একদিকে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে বন, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে জমি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আকারভেদে একটি ইট ভাটা গড়তে কমপক্ষে পাঁচ একর (৫০০ শতাংশ) জমি প্রয়োজন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ৪০ থেকে ৪৫ একর জমিরও প্রয়োজন হয়। আর এসব ইট ভাটা গড়ে ওঠার কারণে তিন হাজার একর ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইট ভাটার ম্যানেজার জানালেন, সাধারণত মধ্যম সারির একটি ভাটায় বছরে ৪০ থেকে ৫০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর প্রতি আট হাজার ইটের জন্য কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার হয় এক হাজার ঘনফুট মাটি। সেই মাটির জোগান আসে কৃষি জমি থেকে। এজন্য প্রতিটি ভাটায় বছরে পাঁচ থেকে ছয় একর জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার করা হয়। সে হিসাবে গড়ে ৭০টি ভাটাতে প্রতি বছর অন্তত সাড়ে ৩০০ একর জমির মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ইট পোড়ানোর জন্য প্রতিটি ভাটায় দৈনিক গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ মণ কাঠ পোড়াতে হয়। সে হিসাবে গড়ে ৭০টি ইটভাটায় প্রতিদিন ২ হাজার ৪৫০ মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। কাঠ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, বিভিন্ন গ্রাম থেকে সংগৃহীত কাঠ এসব ভাটায় জোগান দেওয়া হয়। গড়ে প্রতিটি গাছ থেকে সাত থেকে আট মণ কাঠ পাওয়া যায়। অনেক ভাটায় গাছ চেরাই করতে বসানো হয়েছে করাত কল। এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিভাগের বিভিন্ন ইট ভাটায় আম, জাম, রেন্ট্রি, কদম, জামরুল, কাঁঠাল, খেজুর, নারকেলসহ তিন শতাধিক ফলজ ও বনজ গাছ পোড়ানো হচ্ছে প্রতিদিন। অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর ৭ ধারা অনুযায়ী কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে প্রথমবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ১ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও সাজার বিধান রাখা হয়েছে। তৃতীয়বার এ অপরাধের পুনরাবৃত্তিতে ভাটার নিবন্ধন বাতিল ও ভাটা বাজেয়াপ্ত করারও বিধান রাখা হয়েছে। কাগজে-কলমে এসব আইন বাস্তবায়নে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই!
এদিকে, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-তে বলা হয়েছে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, হাট-বাজার এলাকা; সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর; এবং বন, অভয়ারণ্য, বাগান, জলাভূমি ও কৃষি জমিতে ইট ভাটা স্থাপন করা যাবে না। তবে আইনের তোয়াক্কা না করেই বরিশালের অধিকাংশ ইট ভাটা স্থাপন করা হয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন ফসলি জমিতে। ইট ভাটার ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ ছাড়াও স্থানীয়রা নানা ধরনের সমস্যার কথা জানাচ্ছেন।
কলশকাঠী গ্রামের কৃষক মনিরুল ইসলামসহ স্থানীয় কয়েকজন কৃষক বলেন, ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষেতের পাশে ইট ভাটা গড়ে ওঠায় আগের তুলনায় উৎপাদন কমে গেছে। সরকার ফসলি জমির ওপর ইট ভাটা স্থাপন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পাঁচ বছরের মধ্যে এসব জমির উৎপাদন শূন্যে নেমে আসবে। স্থানীয়রা আরও বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের মধ্যে শ্বসনতন্ত্রের রোগব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে অসুস্থতা বেড়েছে।
বরিশাল সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা জায়, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যদি কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়, তাহলে এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্টসহ শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের প্রকোপ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। ফলে এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।
ইট ভাটার জ্বালানি হিসেবে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে অধিকাংশ ভাটার মালিক বলেন, চাহিদার তুলনায় কয়লার সরবরাহ কম। দামও বেশি। তাই কয়লা দিয়ে ইট পোড়ালে তাদের লভ্যাংশ কমে যায়। ফলে লাভ বাড়াতেই তারা কাঠ পুড়িয়ে থাকেন। সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ কয়লা আমদানির মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে সরবরাহ করতে পারলে তবেই ইট ভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধ করা যাবে বলে মনে করছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা জায়, কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কাটা হলে এর উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে জমিতে ফসল উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে যায়। ফসলি জমির মাটি কেটে ভাটায় ব্যবহার বন্ধে ও ফসলি জমির পাশে ইটভাটা স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে অনুরোধ জানাব।
আইন অমান্য করে কাঠ পোড়ানো, বসতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশেই ভাটা পরিচালনা করে চলে আসা এসব অনিয়মের বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো: আব্দুল মালেক মিয়া জানান, আইন আমান্য করে পরিচালিত ইট ভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।