প্রতিনিধি ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ , ৫:৩১:১৬ প্রিন্ট সংস্করণ
মজিবর রহমান নাহিদ ॥ বিচ্ছিন্ন দীপজেলা ভোলার সাথে বিভাগীয় শহর বরিশালের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। দীর্ঘ বছর ধরে এই নৌ পথে চলাচল করে আসছে ছোট ছোট লঞ্চ। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন রুটে বিলাসবহুল লঞ্চ চলাচল করলেও এ রুটে সেই পুরনো লঞ্চই চলাচল করছে। এদের মধ্যে সিংহভাগ লঞ্চই ফিটনেসবিহীন। লঞ্চগুলো পুরনো হলেও বাড়েনি যাত্রী সেবার মান। পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারন যাত্রীদের। জানা যায়, ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বরিশাল টু ভেদুরিয়া (ভোলা) রুটে প্রতিদিন কয়েক হাজার যাত্রী চলাচল করে। লঞ্চগুলো বেশিরভাগ সময়েই অতিরিক্ত যাত্রী বহন করে চলাচল করতে দেখা যায়। কোন ধরনের নীয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই এসব লঞ্চের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে। আর এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করলেই যাত্রীদের বিভিন্নভাবে হয়রানী করে থাকেন লঞ্চের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ভোলার বোরহানউদ্দিনের নিজাম ফরাজী নামে এক ব্যবসায়ী জানান,‘আমি প্রায়ই ভোলা-বরিশাল লঞ্চে যাতায়াত করে থাকি, বিভিন্ন সময়ে লঞ্চের স্টাফরা নানা অজুহাতে বেশি ভাড়া নিয়ে থাকেন। এর বিরুদ্ধে কথা বললেই লঞ্চের সব স্টাফরা মিলে খারাপ ব্যবহার করেন। এটা কোন ধরনের নিয়ম বুঝতে পারলাম না।’ এমন অভিযোগের ভিত্তিতে পরিচয় গোপন করে দৈনিক আজকের তালাশ’র অনুসন্ধানী মাধ্যম লাহারহাট লঞ্চঘাট থেকে যাত্রা শুরু করেন ভোলার ভেদুরিয়া লঞ্চঘাটের উদ্দেশ্যে। গত ১লা সেপ্টেম্বর একটি মোটরসাইকেল নিয়ে লাহারহাট ঘাটে লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন আমাদের অনুসন্ধানী মাধ্যমের দুই সদস্য। আনুমানিক বেলা ১২টায় ঘাটে এসে পৌঁছায় মেসার্স মুলাদী নেভিগেশন কোং এর এম এল তাজ-১ নামে একটি লঞ্চ। তখন লঞ্চের কেরানীর সাথে কথা বললে তিনি জানান ভেদুরিয়া ঘাটে যেতে আপনাদের জন্য নির্ধারিত ভাড়া ১শ’ টাকা। পরে মোটরসাইকেল নিয়ে ওই দুই সদস্য নিজেরাই লঞ্চে উঠতে চাইলে লঞ্চের দুই স্টাফ বাঁধা দিয়ে তারা গাড়িটি নিজেরা লঞ্চে উঠিয়ে দেয়। গাড়িটি লঞ্চে ওঠানোর পরপরই এসে উপস্থিত হয় ঘাট ইজারাদারের স্টাফ পরিচয়ে এক যুবক। তিনি জানান, গাড়ি লঞ্চে উঠাতে হলে ৫০টাকা ঘাট ইজারা দিতে হবে। ঘাটে মোটরসাইকেলের সরকারী নির্ধারিত মূল্যতো ২৫ টাকা আপনাকে কেন ৫০টাকা দিতে হবে এমন প্রশ্নে উত্তেজিত হয়ে ওই যুবক বলেন,‘৫০ টাকা দিলে দেন না হলে গাড়ি নামান, বেশি কথা বলার সময় আমার নাই।’ রাসেল নামে ওই ইজারাদার বলেন,‘ফেরীঘাটে মোটরসাইকেলের জন্য ২৫টাকা নেওয়া হয়, আমরা ৫০ টাকা করে নেই।’ মোটরসাইকেলের জন্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কত টাকা জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘সরকারের নির্ধারিত ফি কতো সেটা আপনার প্রয়োজন হলে বন্দর অফিসে গিয়ে জানেন। আমাদের এখানে আবার সরকারী কর্মকর্তা, পুলিশ, সাংবাদিক অনেককে ফ্রি ছেড়ে দিতে হয়, অনেক ব্যপার আছে।’ একটি বিস্বস্ত সূত্র জানান, লাহারহাট ঘাটের ইজারাদার রাসেল নামে এক ব্যক্তি। রাসেল ওই ঘাটের ইজারা নেওয়ার পর থেকেই যাত্রীদের সাথে অতিরিক্ত মাত্রায় খারাপ ব্যবহার করে থাকেন তার নিয়োজিত সাঙ্গোপাঙ্গোরা। লঞ্চ ঘাট ত্যাগ করার পরপরই লঞ্চের কেরানী এসে ৩টি টিকিট ধরিয়ে দেয়। যাহার নং- ৫৮৩৯, ৫৮৪০, ৫৮৪১। টিকিট তিনটি ধরিয়ে দিয়ে তিনি ২শ’ টাকা দাবী করেন। ১শ’ টাকার ভাড়া হঠ্যাত ২শ’ টাকা কেন হয়ে গেলো জানতে চাইলে ওই কেরানী বলেন,‘গাড়ির ভাড়া ১শ’ টাকা আর আপনাদের দুইজনের ভাড়া ১শ’ টাকা।’ আপনিতো আমাদের সর্বমোট ১শ’ ভাড়া বলে উঠিয়েছেন এখন কেন ২শ’ টাকা চাচ্ছেন, আগেই ২শ’ টাকা বললেই হতো এমন প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন ওই কেরানী। পরে বাধ্য হয়ে তার দাবীকৃত ২শ’ টাকাই পরিশোধ করেন আমাদের টিমের সদস্যরা। এদিকে লঞ্চটিতে ছিলো যাত্রীতে টইটুম্বুর, লঞ্চের কোন স্থানেই জায়গা খালি ছিলো না, সর্বত্রই ছিলো যাত্রীদের চাপ, তাই আমাদের টিমের সদস্যরা বাধ্য হয়ে মাষ্টার বিজ্রের সামনে দাঁড়িয়েই ছিলেন দীর্ঘ এই পথ। শুধু আমাদের সদস্যরাই নয়, প্রায় ২০জন যাত্রী গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই স্থানে। লঞ্চটি স্টাফ সহ সিংহভাগ যাত্রীদের মুখেই ছিলোনা কোন মাক্স। লঞ্চটি ভোলা ফেরীঘাটের কাছাকাছি পৌঁছালে উপস্থিত হন লঞ্চে গাড়ি উঠানো সেই দুই স্টাফ। তারা জানান, ‘আমরা গাড়ি উঠিয়েছি আমাদের ৫০ টাকা দিতে হবে।’ গাড়ির ভাড়াতো আমরা পরিশোধ করেছি কিন্তু এখন আবার কিসের টাকা জানতে চাইলে পাশ থেকে লঞ্চের চালক বলেন,‘ওদের বেতন দেয়া হয় না আর ওদের দাবীকৃত টাকা না দিলে গাড়ি নামাতে পারবেন না।’ এটা কিসের টাকা প্রশ্ন করলে তিনি জানান,‘এটা লেবার মানি, সবাইকেই এ্যাগো টাকা দিয়া যাইতে হয়। এখানে কোন বড় মেয়া, ছোড মেয়া কামে আয় না।’ তখন চরফ্যাশনের মাইনুল নামে এক যাত্রী আক্ষেপ করে বলেন, আপনারা মনে হয় লাহারহাট ঘাট দিয়ে উঠছেন তাই বোঝেন না, বরিশাল ঘাট দিয়া ওঠলে কিডনি বিক্রি কইর্যা হ্যাগো টাকা দেওয়া লাগতো।’ এর কিছুক্ষণ পরেই ভেদুরিয়া ঘাটে পৌঁছায় লঞ্চটি। লঞ্চ ঘাটে পৌঁছানোর পরে গাড়িটি নামানোর চেষ্টা করা হলে সাথে সাথেই বাঁধা দেয় ওই দুই স্টাফ, তারা তাদের দাবীকৃত ওই টাকা না দিলে গাড়ি নামাতে দেবে না বলে জানান। তাদের দাবীকৃত টাকা পরিশোধ করার পরে অন্য দুইজন লোক জোড়পূর্বক লঞ্চ থেকে গাড়িটি ঘাটের র্টামিনালে নামান। গাড়িটি নামিয়ে দিলে আমরা পল্টন ছেড়ে রাস্তায় উঠলে ওই দুই ব্যক্তি গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। তারাও এসে আবার টাকা দাবী করেন। কিসের টাকা জানতে চাইলে তারা জানান,‘এটা লেবার মানি, আমরা গাড়ি নামিয়ে দিয়েছি টাকা দিবেন তারপর গাড়ি নিয়া যাবেন।’ আমরাতো আপনাকে গাড়ি নামাতে বলিনি, আপনি কেন জোড়পূর্বক গাড়ি নামিয়ে এখন টাকা দাবী করছেন এমন কথা বলায় তিনি বলেন,‘বেশি ঘার ত্যারামি করলে এখন ঘাট ভাড়াও দেবেন আর লেবার মানিও দেবেন। ভালোয় ভালোয় টাকাটা দিয়া কাইট্যা পরেন।’ পরে তাদের দাবীকৃত ৫০টাকা দিয়ে আমাদের দুই সদস্য সামনে আগাতে চাইলেই আরেকজন ঘাট শ্রমিক পিছন থেকে ডাক দিয়ে বলেন, ‘আপনারা মনে হয় কখনো লঞ্চে যাতায়াত করেন নাই, অতিরিক্ত বিপদে না পড়লে কেউ লঞ্চে গাড়ি নিয়া যাতায়াত করে না, যারা করে তাগো গাড়ি বেইচ্যা হইলেও আমাগো টাকা দিয়া যাইতে হয়।’ ভোলা নদী বন্দরের সহকারী পরিচালক মোঃ শহিদুল ইসলাম দৈনিক আজকের তালাশকে জানান, ‘যাত্রীরা সম্মানিত ব্যক্তি, তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার অত্যান্ত দুঃজনক বিষয়, আমারা দ্রুত বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ প্রিয় পাঠক এবার বরিশাল ফেরার পালা তবে লঞ্চ নয় এবার আমাদের টিমের সদস্যরা ফিরবেন ফেরীতে। ভোলা টু লাহারহাট ফেরীতেও যাত্রীদের পদে পদে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। যার বিস্তারিত দেখতে চোখ রাখুন আমাদের ২য় অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।