প্রতিনিধি ১২ মে ২০২০ , ১:২৭:৫৫ প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকা:
করোনা ভাইরাসের কবলে পড়ে সারা বিশ্বের মতো থমকে গেছে দেশের অর্থনীতি। এ অবস্থায় অর্থনীতির চাকা সচল করতে হলে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিয়ে ‘লকডাউন পরিস্থিতি’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, লকডাউন পরিস্থিতির কারণে এপ্রিল মাসজুড়ে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে জুনেও প্রকল্প বাস্তবায়নে খুব বেশি গতি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। এ অবস্থায় বিরাট অংকের টাকা অব্যয়িত থাকতে পারে। এ কারণে মানুষকে সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থনীতির কথাও চিন্তা করতে হবে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। যার মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়ে ১৬ মে পর্যন্ত করা হয়।
গত দেড় মাসে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভীত নড়ে গেছে। সরকারি সিদ্ধান্ত মতে দেশের কোনো কোনো জেলা-উপজেলায় আবার পুরোপুরি লকডাউন চলমান। এ কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধের পাশাপাশি অর্থনীতির সব চাকা স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ৩৩০০ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির আকার ২ লাখ ১০ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত অব্যয়িত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। ৪৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এডিপি অগ্রগতির হার ৫০ শতাংশের নিচে। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সংক্রমণ সহনীয় পর্যায়ে চলে এলে লকডাউন প্রক্রিয়া শিথিল করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে যখন সংক্রমণের মাত্রা উর্ধ্বমুখী, তখন এটা শিথিল করা হলো। এর ফলে আমার মনে হয়, ঈদের পরে করোনার প্রভাব বড় আকার ধারণ করবে। ঈদের আগে সরকার তেমন কিছু খুলবে না। কারণ কয়েকদিন পরেই ঈদের ছুটি শুরু হবে।
তিনি বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক যে অবস্থা তাতে বেশি দিন লকডাউন দিয়ে থাকা যাবে না। কারণ সাধারণ মানুষের পেটে টান পড়বে। এজন্য হয়তো আমাদের সব কিছু খুলে দিতে হবে। ঈদের পরে তো খুলতেই হবে সেটা রাজনীতি বা অর্থনীতির কারণে। আমাদের ভয় হলো তখন যে স্পাইকটা আসবে সেটা আমরা কিভাবে সামলাবো। সেজন্য আমরা স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় কী পদক্ষেপ নিয়েছি বা প্রস্তুতি কোন ধরনের আছে সেটা দেখতে হবে। আমরাতো সে রকম কিছু দেখছি না। আমাদের চায়না থেকে ডাক্তার নার্সদের এনে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকার সেটা করেনি।
অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে ঈদের পর লকডাউন প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে সরকারকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিছু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রস্তুতি নিতে হবে। যেমন- হাসপাতালের সংখ্যা বাড়াতে হবে, ডাক্তার নার্সদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
সরকার ঘোষিত লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজকে তিনি ‘ভালো’ বলে মন্তব্য করলেও এই মুহূর্তে এটার তেমন প্রয়োজন ছিল না বলে মনে করেন।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজের (বিআইডিএস) অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত থিওরিটিক্যালি লকডাউন তুলে দেওয়া উচিত না। কিন্তু অর্থনীতির কারণে এটা সম্ভব না। আবার সরকার যে স্বাস্থ্যবিধির কথা বলছে, তা সব স্থানে মানা সম্ভব নয়। এজন্য সরকারকে দুই মাসের পরিকল্পনা নিতে হবে।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যেতে হবে। তবে পরিকল্পনাটা আগে দরকার। মানুষকে বিকল্প ব্যবস্থা দিতে হবে, অনলাইন প্লাটফর্ম জোরদার করতে হবে, এলাকাভিত্তিক মোবাইল অপারেটরদের সম্পৃক্ত করতে হবে। যতোটা সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে আগামী কয়েক মাস। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সেবাও বাড়াতে হবে।
ড. নাজনীন বলেন, সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়া সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য দুই হাজার কোটি টাকার একটা ফান্ড দিয়েছে। সেখান থেকে নিঃশর্তে একটা অংশ একেবারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য দিতে হবে আগামী তিন মাস। যাতে করে তারা চলতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সম্প্রতি ‘অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরো মে মাস লকডাউন পরিস্থিতি থাকলে ক্ষতির পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকা (গত অর্থবছরের জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ) ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড় খাত- কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত ধরে ক্ষতির অনুমিত হিসাব দেওয়া হয়েছে সমীক্ষা প্রতিবেদনে। হিসাবে লকডাউনের কারণে প্রতিদিন কৃষিতে ক্ষতি হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষির প্রধান উপখাতগুলো হল শস্য উৎপাদন, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য সম্পদ। স্বল্পমেয়াদে এসব উপখাতে উৎপাদন না কমলেও দেশি-বিদেশি অর্থনীতি অবরুদ্ধ থাকায় এসব উপখাতের উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যের ওপর নিম্নমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। আর শিল্প খাতে দিনে ক্ষতি হচ্ছে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা। উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে ক্ষতির মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ খাতে প্রতিদিনের অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা। সেবা খাতে দিনে ২০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অর্থনৈতিক ক্ষতি সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে সেবা খাতে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বেচাকেনা এবং জরুরি সেবা ছাড়া এই খাত মূলত অবরুদ্ধ। সব ধরনের যোগাযোগ (সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ পথ) পর্যটন, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, রিয়েল এস্টেটসহ সব ধরনের সেবা একেবারেই বন্ধ। স্বাস্থ্য খাতের বেসরকারি অংশটিতেও এক প্রকার অচলাবস্থা বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে সেবা খাতে প্রতিদিনের অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকা।
এদিকে বৈশ্বিক দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনার সংক্রমণ অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার সরকারি প্রাক্কলনের অর্ধেকেরও বেশি কমে ২-৩ শতাংশের মধ্যে নেমে যেতে পারে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এ অর্থবছর তা ৮ দশমিক ২ শতাংশে নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। জিডিপির আকার ছিল ২৫ লাখ ৪২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের হিসাবমতে ৩ শতাংশ জিডিপি কমলে অর্থবছর শেষে জিডিপি ১ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকা কম হবে। জিডিপি আরও বেশি কমার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
বিজিএমইএর দেওয়া তথ্যমতে, ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ৩২০ কোটি ডলার বা ২৭ হাজার ২০০ কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শুধু পোশাক খাতেই ক্ষতি হবে ৪২ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। তবে সংক্রমণের ঝুঁকি উপক্ষো করে এরইমধ্যে শত শত কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে এ খাত ফের মুখ থুবড়ে পড়বে।
এদিকে করোনা মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় এক লাখ কোটি টাকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, তার মধ্যে শিল্পঋণ খাত পাবে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাত পাবে ২০ হাজার কোটি টাকা। এ প্যাকেজে রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকা; নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ডের জন্য ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা; প্রিশিপমেন্ট ঋণ বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকা; গরিব মানুষের নগদ সহায়তা বাবদ ৭৬১ কোটি টাকা; অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা এবং স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
যদিও এ প্যাকেজের অধিকাংশ টাকার সংস্থানই হবে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে। কেবল প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণে সুদ ভর্তুকি বাবদ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা এবং রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সংস্থান বাজেট থেকে হবে। এছাড়া গরিব মানুষের নগদ সহায়তা বাবদ ৭৬১ কোটি টাকা, ১০ টাকা কেজিতে চাল দেওয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা, স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দের টাকাসহ বেশ কিছু অর্থ বাজেট থেকে সংস্থান করা হবে। এ প্যাকেজের অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য দিক-নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপশি পর্যবেক্ষণও করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।