প্রতিনিধি ২ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ৬:৪৪:৪৭ প্রিন্ট সংস্করণ
★পরচা বাবদ নিচ্ছে ২০০-৩০০ টাকা
★ দাখিলা তৈরিতে নিচ্ছে অতিরিক্ত ফি
★বহিরাগত লোক দিয়ে পরচা লেখানো’র অভিযোগ
তালাশ প্রতিবেদক ।।
বরিশাল সদর উপজেলার ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। যার মধ্যে অন্যতম চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিস। এই ভূমি অফিসেও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করতে দেখা গেছে।
গত সোমবার বেলা ১২ টায় চরমোনাই ভূমি অফিসে রাজারচর গ্রাম থেকে জমির পরচা ও দাখিলা নিতে আসা নিজাম খলিফা বললেন, চরমোনাই ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক রিপন প্যাদার দুর্নীতি ও সাধারন মানুষকে হয়রানির কথা।
এখানে (ভূমি অফিস) পরচা, দাখিলা সহ বিভিন্ন কাগজপত্র নিতে পদে পদে টাকা দিতে হয়। এমনকি টাকা না দিলে কোন কাজই ঠিকমতো হয়না বলেও জানান ভুক্তভোগী নিজাম খলিফা।
এসময় নিজাম খলিফা প্রতিবেদকদের বলেন, চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক রিপন প্যাদার দুর্নীতির কথা। তিনি বলেন,জমির পরচা উঠাতে ২০০-৩০০ টাকা দিতে হয়তো বটেই তাছাড়া ঘন্টাব্যাপি দাড়িয়েও থাকতে হয়।
এই রিপন প্যাদার কাছে আমি (নিজাম) ১টা দাখিলার জন্য ২০০ টাকা দেই। কিন্তু তিনি ২০০ টাকা ফেরৎ দিয়ে রাগান্বিত হয়ে বলেন, ৩৫০ টাকা লাগবে নাহলে দাখিলা করা যাবেনা। এমনকি তিনি (রিপন) বলেন, যদি ২০০ টাকা দেন তাহলে সরকারের খাতায় কতো টাকা উঠাবো আর আমরাও বা কতো টাকা রাখবো।
এদিকে ভূমি অফিসে সাংবাদিকরা উপস্তিত হলে চরমোনাই ভূমি অফিসে স্থানীয় বেশ কয়েকজন দালালদের উপস্তিতি দেখতে পাওয়া যায়। হঠাৎ সাংবাদিকদের উপস্তিতি টের পেয়ে ৩-৪ জন লোক ভূমি অফিস ত্যাগ করেন। স্থানীয়দের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এই রিপন প্যাদা চরমোনাই অফিস সহায়ক পদে ২০১২ ইং সাল থেকে চলমান বছর (২০২০ইং) পর্যন্ত আমাদের চরমোনাই ভূমি অফিসেই কর্মরত আছেন।
এসময় স্থানীয় সুশিল সমাজের আরও অনেকে বলেন, রিপনের বাড়ি চরমোনাই ইউনিয়নের চর-হোগলা গ্রামে হওয়ায় ক্ষমতা বলে একই ভূমি অফিসে কর্মরত আছেন। এসব দালাল রিপন প্যাদার ছত্র ছায়ায় ভূমি অফিসের দালালী করেন। তাছাড়া উপজেলার ভূমি অফিসগুলো ঘুরলে এ কথা সহজেই বলা যায় এখানে ‘দুষ্টের লালন আর শিষ্টের দমন’ চলে।
একদিন সূর্য আকাশে নাও উঠতে পারে কিন্তু ভূমি অফিসে ঘুষ না দিয়ে কাজ করানো সম্ভব হয়না সে তিনি যেই হোন না কেন। স্হানীয়দের অভিযোগ কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রভাব খাটালেই কাজ দ্রুত হয় এবং কাজ সমাধান করে থাকেন ভূমি অফিসে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মাচারি’রা।
ঘুষ তখনও দিতে হয় ‘বকশিশ’ এর নামে। এদিকে বুখাইনগর বাজার ব্যাবসায়ী নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, পরচা উঠাতে ভূমি অফিসে গিয়েছি। সেখানে টাকা ছাড়া কোন কাজ হয়না। এদিকে চরমোনাই ভূমি অফিসের কর্মরত ঝাড়ুদার (আয়া) সাংবাদিকদের সামনেই কাগজ দোকানে দিয়ে আসবো ৫০ টাকা বকশিশ দিতে হবে বলে ব্যাবসায়ীকে জানান।
সেই ব্যাবসায়ী ভূমি অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে এই প্রতিবেদককে তার কাছে পরচা উঠানোর জন্য কতো টাকা দিতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কম হলেও ২০০-২৫০ টাকা। ভূমিদস্যু, জমির দালাল, জমি আত্মসাত্কারীদের স্বর্গরাজ্য যেন সদর উপজেলার ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতেই।
গ্রামের সাধারণ জমির মালিকরা ভূমি অফিসে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন এমনটাই বলেছেন রাজারচর গ্রামের বিষ্ন চন্দ্র। তিনি চরমোনাই’র রাজারচর মৌজার পরচা ও দাখিলা কাটতে অতিরিক্ত ফি দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিকে পরচা উঠানোর টাকা কাকে দিতে হবে জানতে চাইলে ভূমি অফিসের সহকারী কর্মকর্তা বিষ্ন চন্দ্রকে বলেন, যে লিখেছে তাকেই দেন।
সেসময়ে অফিস সহায়ক রিপন প্যাদা অফিসে বসে পরচা লেখছিলেন। বাইরে গিয়ে কাকে টাকা দেবে বিষ্ন চন্দ্র জানতে চাইলে সহকারি কর্মকর্তা ও অফিস সহায়ক কোন উত্তর দিতে পারেনি। তাতেই প্রতিবেদকরা বুঝতে পেরেছে চরমোনাই ভূমি অফিসে বহিরাগত/দালাল দিয়েও বিভিন্ন কাজ করানো হয়। সদর উপজেলার ১০ টি ইউনিয়ন ঘুরে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা যানা যায়। ভূমি অফিসগুলোর কর্মকর্তাদের মদদে দালালচক্র অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। ভুক্তভোগী লোকজনের অভিযোগ, বৈধ কাজে গিয়েও প্রকৃত মালিকদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়।
অফিসের কর্মকর্তাসহ সকলকে দালাল বা উমেদারের মাধ্যমে ম্যানেজ করে খারিজ পার করতে হয়। আবার অনেক সময় জমির মালিকরা টাকা দিয়েও জমি খারিজ করতে গিয়ে তিন চার মাস হয়রানির শিকার হয়েছেন বলেও জানা গেছে। হয়রানির শিকার ভুক্তভোগীরা জানান, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ভূমি অফিসের দালাল ও উমেদারের উত্পাতে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ।
দালাল, উমেদার, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই মিলে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। দালাল বা উমেদারকে টাকা দিলে তদন্ত প্রতিবেদন, সার্ভে রিপোর্ট আর নামজারি খতিয়ানের অবৈধ কাগজ বের করাও কোন বিষয় না। এদিকে প্রতিবেদকের পরিচয় গোপন রেখে ভূমি অফিসের এক বহিরাগত/দালালের কাছে জানতে চাইলে নাম না প্রকাশ করা শর্তে তিনি বললেন, টাকা খরচ করলে যে কোনো জমির দলিল নিজের নামেও করা সম্ভব। পরে, মামলায় টিকুক আর না টিকুক কিন্তু করা সম্ভব। তিনি বলেন, ‘আমি টাকা নিয়ে কাজ করে দেই- না হলে খাবো কি।
ক্রমবর্ধমানে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা শিল্প এলাকা হওয়ার কারণে জমির দাম হু হু করে বাড়ছে। তাই এখানে জমি সংক্রান্ত জটিলতাও খুব বেশি। বরিশাল শহরের কাছে বিভিন্ন ভূমি অফিস অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আর দালাল এবং উমেদার পরিবেষ্টিত ইউনিয়ন ভূমি অফিসগুলোতে চলছে রমরমা ঘুষ বাণিজ্য। টাকা ছাড়া পরচা, খাজনা-খারিজসহ ভূমি সংক্রান্ত কোন সেবা ঠিকমতো পাওয়া যায় না। খাস জমি, বনের জমি, এক জনের জমি অন্যের নামে নামজারি করে দেয়াসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে তাদের অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন বলেও জানান ভুক্তভগিরা।
এসব ভূমি অফিসকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল দালাল চক্র। দালাল/উমেদার’রা সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোন বেতন পান না। জমির মালিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত উৎকোচ থেকে তারা ভাগ পান। গত এক সপ্তাহ ধরে উপজেলার সব ভূমি অফিসগুলোতে ঘুরে বিভিন্ন কাজে আসা লোকজনের সাথে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার চরমোনাই ভূমি অফিস ‘লোভনীয়’ অফিসগুলোর মধ্যে অন্যতম।পরচা নিতে কোনো টাকা লাগে কিনা তা বরিশাল সদর উপজেলা সহকারি কমিশনার(ভূমি)তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে পরচা দেওয়ার কোন নিয়ম নেই। এমনকি টাকা লেনদেন তো দুরের কথা। যদি এসব অনিয়ম কারও বিরুদ্বে পাওয়া যায় তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্হা নেয়া হবে।
অফিস সহায়ক রিপন প্যাদা বলেন, পরচা কষ্ট করে লিখতে হয় বিধায় টাকা নেই। প্রতিবেদকরা টাকা নেওয়ার বিষয়টা অনিয়ম জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার সিনিয়র অফিসার গাজী সিদ্দিকুর রহমান স্যার আছেন। তিনিই আমার বিষয়টি দেখবেন। এ বিষয়ে চরমোনাই ইউনিয়ন সহকারি (ভুমি) কর্মকর্তার কাছে জিগ্গেস করলে তিনি কোনো সমাধান দেননি।
এদিকে চরমোনাই ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক রিপন প্যাদার এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি থেকে বাচতে প্রশাসনের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন এলাকাবাসি।