প্রতিনিধি ২০ জানুয়ারি ২০২১ , ৬:৪৭:০৩ প্রিন্ট সংস্করণ
প্রভাষক আমিনুর রহমান শামীম॥ আমাদের আসাদ, আমাদের গর্ব! আজ গণঅভ্যুত্থান দিবস, ইতিহাসের পাতায় যা ‘শহীদ আসাদ দিবস’ নামেই সর্বাধিক পরিচিত। ১৯৬৯ সালের আজকের এদিনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত সমাবেশে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ।
ষাটের দশকজুড়ে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে এবং বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। তারই প্রবল বিস্ফোরণ ঘটেছিল ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি। তবে ২০ জানুয়ারি আসাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ লাভ করে। আইয়ুব সরকারের পতন হয়। এসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে।
শহীদ আসাদ ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার ধানুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম আলহাজ মোহাম্মদ আবু তাহের। শিবপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন । ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীতে ভর্তি হন আসাদ। ১৯৬৯ সালে মৃত্যুকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
১৯৬২ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব বাঙালি দালালদের সঙ্গে নিয়ে বাঙালি জাতির সংস্কৃতিতে আঘাত হনে। বাঙালিদের চাপিয়ে দিতে চায় পাকিস্তানি সংস্কৃতি। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব জনরোষকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করার জন্য পাক-ভারত যুদ্ধ লাগিয়ে দেন কাশ্মীরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে লাহোরে ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন। ৬ দফা হয়ে দাঁড়ায় বাঙালির মুক্তি সনদ। ১৯৬৭ সালে ৬ দফার জনপ্রিয়তা ধ্বংস করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করে বঙ্গবন্ধুকে এক নম্বর আসামি করা হয়। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐতিহাসিক ১১ দফাও ৬ দফার মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১১ দফাকে সমর্থন করেন মওলানা ভাসানী, পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা জনতার দাবিতে পরিণত হয়।
এসময় চলছিল ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের সামরিক আদালতে আগরতলা মামলার আসামিদের প্রহসনের বিচার। তাদের হত্যার নীলনকশা করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মওলানা ভাসানীকে আন্দোলনের হাল ধরার অনুরোধ করেন। পরদিনই মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে বিশাল জনসমাবেশে বক্তৃতা দেন। আন্দোলন দমন করার জন্য আইয়ুব সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছিল।
১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন দুঃসাহসী ছাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রতিবাদ সভা ও শোভাযাত্রা বের করেছিল। কয়েক হাজার পুলিশ-ইপিআর ওই ছাত্র মিছিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ২০ জানুয়ারি ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। সেদিন জনতার মারমুখী প্রতিবাদের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল পুলিশ-ইপিআর। অকেজো হয়ে গিয়েছিল কাঁদানে গ্যাস। সব বাধা অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে বেরিয়ে বিরাট শোভাযাত্রা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে যায়। মেডিকেল কলেজের সামনে সেই শোভাযাত্রায় পাকিস্তান পুলিশ এবং ইপিআর বাহিনীর বুলেটের আঘাতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন মাস্টার্সের ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ।
তার মৃত্যুতে ’৬৯-এর গণআন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। জনতা আসাদের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে মুখোমুখি লড়েছিল সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে। ২৪ জানুয়ারি প্রতিবাদ দিবস ছিল কিন্তু দিবসটি রূপান্তরিত হয় গণঅভ্যুত্থান দিবসে। দেশব্যাপী হরতাল পালন করা হয় সেদিন।
জনতার ওপর বার বার গুলিবর্ষণে ছাত্রসহ ৬ জন নিহত ও বহু আহত হয়েছিল। সচিবালয়ের গেটে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন শেখ রুস্তম আলী, মকবুল আর নবকুমার স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান। বিক্ষুব্ধ জনতা শহীদ মতিউরের লাশ নিয়ে ঢাকার সর্ববৃহৎ শোভাযাত্রা বের করেছিল।
আর সেদিনই জনতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিস। আরো পুড়েছিল আগরতলা মামলার প্রধান বিচারক এস রহমানের বাসভবন, সরকারি অতিথিশালা, নবাব আসকারির বাড়ি, রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধকারী খাজা শাহাবুদ্দীনের আবাস।
গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পেছনে আসাদ ও মতিউরের আত্মদান মূল ভূমিকা পালন করেছে। তারা আমাদের জাতীয় বীর। তারা বাঙালির হৃদয়ে স্থান পেয়েছেন। কবি শামসুর রাহমান তার কবিতায় আসাদ ও মতিউরকে দিয়েছেন অমরত্ব।