প্রতিনিধি ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ , ৭:৩২:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ
রাজশাহী: বাংলার প্রকৃতিতে এখন পুরোদমে শীতের আমেজ। কাকডাকা ভোরে ঘন কুয়াশার চাদর।
শরীর হিম করা উত্তুরে বাতাস। দুপুরের বাতাসে ত্বকে শুষ্ক আর্দ্রতা। সবই দৃশ্যমান এবং অনুভূত হচ্ছে হাড়ে হাড়।
বাংলার বৈচিত্র্যময় প্রকৃতিতে প্রতিটি ঋতুই ধরা দেয় আলাদা সৌন্দর্যে। বর্ষায় বৃষ্টি আর শীতের কুয়াশা ভিন্ন অনুভূতি জাগায় মনে। প্রকৃতিতে যখন শীতের আমেজ তখন ভাপ ওঠানো পিঠার মজা যেন একটু আলাদা। সেই পিঠা তৈরির অন্যতম উপকরণ খেজুরের গুড়। যদি সঙ্গে থাকে এক গ্লাস টাটকা রস, তবে তো তুলনাহীন!কুয়াশাঢাকা শীতের সকালে টাটকা এক গ্লাস খেজুরের রসের সত্যি তুলনা হয় না। এজন্যই মা-খালাদের দেখা যায় খেজুরের রস ও গুড় দিয়ে ভাপাপিঠা, রসপিঠাসহ অন্য পুলিপিঠা বানাতে। পৌষপার্বণ ও আর নবান্ন উৎসবজুড়ে থাকে এর একক আধিপত্য।
খেজুরের গুড় বাঙালি সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীতে খেজুর গুড় তৈরির ধুম পড়ে যায়। গাছিরা সেই ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গাছের রস সংগ্রহ, রস গরম ও গুড় তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন।
আর রাজশাহীর খেজুরের গুড় সুন্দর ঘ্রাণ ও স্বাদের জন্য প্রসিদ্ধ। খেজুরের গুড়ে আখের চেয়ে বেশি পরিমাণে প্রোটিন, ফ্যাট ও খনিজ পদার্থ বিদ্যমান। শীতকালে গ্রামাঞ্চলে খেজুরের রস একটি জনপ্রিয় পানীয়। এছাড়া খেজুরের গুড় দিয়ে মিঠাই, মণ্ডা, সন্দেশ ও রকমারি পিঠা তৈরি করা হয়। এই গুড় দিয়ে তৈরি পিঠা ও পায়েস খুবই সুস্বাদু। কিন্তু গাছ থেকে নামানো কাঁচা রস থেকে কীভাবেই বা তৈরি হয় সেই জমাট বাঁধা সুস্বাদু গুড়? তবে আসুন তা জেনে নেওয়া যাক। রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ষলুয়া গ্রামের আব্দুর রশীদ জানান, গাছ পরিষ্কার করার পর প্রতিদিন গাছ কাটতে হয়, যাতে গাছে রস নিঃসরণ শুরু হয়। কোনো কোনো গাছ কাটা শুরুর তিন থেকে চারদিনের মধ্যেই রস নিঃসরণ শুরু হয়। এরপর কাটা অংশের যেখানে রস নিঃসরণ শুরু হয় সেখানে একটি ইউ আকৃতির চিকন বাঁশের কাঠির আধা ইঞ্চি পরিমাণ গাছে ঢুকিয়ে দিতে হয়।
এরপর ইউ আকৃতির কাঠির মধ্যদিয়ে রস ফোঁটায় ফোঁটায় গাছের ঝুলন্ত হাঁড়ি বা ভাঁড়ে জমতে থাকে। উন্নতমানের খেজুরের গুড় তৈরির জন্য রস সংগ্রহের পর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে রস সেঁকে চুলার ওপর বসানো টিনের তৈরি কড়াইয়ে ঢালা হয়। চুলার ওপর কড়াই বসানোর সময় খেয়াল রাখতে হয়, যাতে কড়াই ও চুলার মধ্যে কোনো ফাঁকা জায়গা না থাকে। আরো খেয়াল রাখতে হবে যেন চুলা থেকে বের হওয়া গরম ধোঁয়া বাতাসে উড়ে কড়াইয়ের রসের সঙ্গে মিশে যেতে না পরে। কারণ এতে গুড়ে এক রকম বাজে ধোঁয়াটে গন্ধ হয়ে যাবে। রস গরম করার প্রথম অবস্থায় রসের উপরিভাগে যে গাদ ভেসে ওঠে তা দ্রুতই ছাঁকনি বা হাতা দিয়ে তুলে ফেলে দিতে হবে। এরপর রস ঘন হলে হাতা দিয়ে অল্প তুলে ফোঁটা ফোঁটা করে ফেলে দেখতে হবে শেষের ফোঁটার আঠালো ভাব দেখা যায় কিনা। গুড় তৈরি করতে এসময় কড়াইয়ের ফুটন্ত ঘনীভূত রস লম্বা হাতলের সাহায্যে লাগাতার নাড়তে হবে এবং রস ঘন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চুলার তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে।
গুড় তৈরির জন্য চুলা থেকে ঘন রস নামানোর সময় নিশ্চিত করতে চাইলে হাতলের সাহায্যে এক চিমটি পরিমাণ গুড় কিছু ঠাণ্ডা পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। দ্রুত জমাট বাঁধলে বুঝতে হবে গুড় চুলা থেকে নামানোর উপযোগী হয়ে গেছে। চুলা থেকে কড়াই নামিয়ে দ্রুত গোলাকৃতি বা চারকোনা খাঁচে ঢেলে ঠাণ্ডা করতে হবে। ব্যাস গুড় তৈরি হয়ে গেলো।
একই গ্রামের গাছি মনিরুজ্জামান জানান, মাটির পাত্রে গুড় সংরক্ষণ তুলনামূলকভাবে খরচ কম। এজন্য অধিকাংশ গুড় ব্যবসায়ী মাটির পাত্রে গুড় সংরক্ষণ করেন।
কোনো কোনো এলাকায় টিনের পাত্রেও গুড় সংরক্ষণ করা হয়। এখান থেকে খেজুরের গুড় জেলার পুঠিয়া উপজেলার বড় মোকাম বানেশ্বর বাজারের পাইকারি আড়তে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ট্রাকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যায়। আর দেশের অভ্যন্তরে খেজুরের গুড়ের চাহিদা পূরণে এই রাজশাহীর ভূমিকাই বেশি। কারণ দেশে রাজশাহীর গুড়ের চাহিদাই বেশি। এরপরই রয়েছে ফরিদপুর ও দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য জেলা।
গাছি মনিরুজ্জামান আরও বলেন বলেন, শীত মৌসুমে খেজুরের গুড়ের ভালো দাম পাওয়া যায়। এজন্য বাজারেও দাম বেশি থাকে। বর্তমানে খেজুরের গুড় পাইকারি ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২শ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।