অপরাধ

বরিশালে ১৫ হাজার টাকার ডাক্তারে করেন সকল রোগের চিকিৎসা!

  প্রতিনিধি ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ , ১১:৫৭:২৯ প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যবস্থাপত্রে বড় বড় ডিগ্রি, এমবিবিএস পাস না করেও তারা সকল রোগের চিকিৎসক। এমনকি করছেন অস্ত্রোপচারও। অথচ তারা পল্লী চিকিৎসক। আরএমপি (রুরাল মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনার) কোর্স করেই এমবিবিএস চিকিৎসকের মতোই করছেন জটিল সব রোগের চিকিৎসা।

 

ডিজিটাল ব্যানার ও চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজের নামে ভিজিটিং কার্ড ও প্যাড ছাপিয়ে আইন অমান্য করছেন। নামের আগে পদবি লিখছেন ‘ডাক্তার/চিকিৎসক’। তাদের ভুল চিকিৎসা, মাত্রাতিরিক্ত ওষুধের প্রেসক্রিপশনের কারণে হরহামেশাই মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের। ডাক্তার রূপধারী এই পল্লী চিকিৎসকদের ওপর প্রশাসনের নজর বা নিয়ন্ত্রণ কোনোটাই নেই। একারণে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন সেবা নিতে আসা শহর ও গ্রামের অসংখ্য মানুষ।

 

জানা যায়, আরএমপি, ডিএএমএফ ও এলএমএএফ কোর্স করে নামের আগে ‘ডাক্তার’ লিখে রোগী দেখলেও এই পল্লী চিকিৎসকদের রোগী দেখার আইনগত অনুমোদন বা যোগ্যতা কোনোটাই নেই। এই চিকিৎসকদের অনেকেই ন্যূনতম এসএসসিও পাস করেননি। সাধারণ রোগীদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরামর্শ প্রদান এবং জটিল-স্পর্শকাতর রোগীদের বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে প্রেরণের নিয়ম। অথচ তারা করছেন ঠিক এর উল্টো। চিকিৎসার নামে সাধারণ-জটিল সকল রোগের অপচিকিৎসা দিয়ে চলেছেন তারা। অসহায় রোগীদের তারা ব্যবহার করছেন ‘গিনিপিগের’ মতো।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরিশালে ডাক্কার রূপধারী পল্লী চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। বরিশাল মহানগরের তুলনায় গ্রাম-গঞ্জে ও উপজেলা শহর এলাকায় এদের দৌরাত্ম্য তুলনামূলকভাবে বেশি। চটকদার সাইন বোর্ড টাঙ্গিয়ে নিজেদের নামের আগে ‘ডাক্তার’ উপাধি আর ‘ডিপ্লোমা, প্যারামেডিক, এলএমএএফ, ডিএইসএস, শিশু বিশেষজ্ঞ, কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার’এর মতো নামে ভারী শব্দ লাগিয়ে দেদারছে অপ-‘চিকিৎসা-বাণিজ্য’ চালাচ্ছেন এরা। চেম্বার খুলে সাইনবোর্ডে নামের সঙ্গে ‘ডাক্তার’ উপাধি ও ডিগ্রির বহর যোগ করে এভাবেই প্রতারণা করে যাচ্ছেন।

 

গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক সংকট থাকায় এবং মানুষের সচেতনতার অভাবকে পুঁজি করে বছরের পর বছর রোগী দেখে যাচ্ছেন তারা। রোগমুক্তি তো দূরের কথা, এসব ভুয়া চিকিৎসকের ওষুধ খেয়ে নানান জটিলতায় ভুগছেন হাজারো রোগী। এছাড়া মাঝেমধ্যেই তাদের ভুল চিকিৎসার কারণে রোগী মারা যাওয়া মতো ঘটনাও ঘটছে। আবার অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে রোগকে আরো জটিল থেকে জটিলতর পর্যায়ে নিয়ে নিরাময়-অসম্ভব করে ফেলছেন। নিজের চেম্বার খোলার পাশাপাশি এসব পল্লী চিকিৎসক ওষুধও বিক্রি করছেন। নিজেই ডাক্তার, নিজেই আবার ওষুধবিক্রেতা।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, বরিশাল শহর ও আশপাশের গ্রাম-গঞ্জে শত শত লাইসেন্সবিহীন ডাক্তার নামধারী চেম্বার খুলে জাঁকিয়ে বসেছেন।

 

আজকের তালাশের সাংবাদিকরা এমন অনুসন্ধান করতে গেলে চরবাড়ীয়া ইউনিয়নের চরআবদানীর খেয়াঘাট রোডে দেখা মেলে খলিলুর রহমানের। তিনি সাইনবোর্ডে লিখেছেন চিকিৎসক মো: খলিলুর রহমান, ডি.এ.এম.এস (ঢাকা), আর.এম.পি (ঢাকা)। বেশ কয়েকদিন তার সাথে দেখা করতে গেলে তাকে না পেয়ে যোগাযোগ করা হয় মুঠোফোনে। সে সময় খলিলুর রহমান জানান তার তিনটি চেম্বার রয়েছে। আজ ওখানে তিনি বসবেন্নায়। রোগী দেখাতে হলে যেতে হবে যমুনা ডায়াগনস্টিক ল্যাবে। রোগী সেজে সাংবাদিকরা উপস্থিত হয় যমুনা ডায়াগনস্টিক ল্যাবে। দেখা মেলে ভুয়া চিকিৎসক মো: খলিলুর রহমানের। তিনি যমুনা ডায়াগনস্টিক ল্যাবের এক কক্ষে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার নামে তার প্যাড ভর্তি করে ওষুধ আর বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়ে পরের দিন দেখা করতে বলেন। অবস্য ২০০ টাকা ভিজিটো রাখেন তিনি।

 

সাংবাদিকরা পরিচয় দিলে ভুয়া চিকিৎসক মো: খলিলুর রহমান বলেন- আমি ৩ মাসের কোর্স করেছি। সেখানের শিক্ষকরা বলেছেন নামের আগে চিকিৎসক লিখতে পারবো। তাই নামের আগে চিকিৎসক লিখেছি। আমি আঠেরো বছর ধরে চিকিৎসা দেই। দিনে বরিশাল কেমিস্টে রোগী টানার কাজ করি। রাতে চিকিৎসা দেই। ইউটিউবে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার ভিডিও দিয়ে থাকি। বিয়ের ১৫ বছরে যারা গর্ভধারণ করতে পারেনি তাদের গ্যারান্টি দিয়ে চিকিৎসা করি।

 

এ বিষয়ে যমুনা ডায়াগনস্টিক ল্যাবের পরিচালক (মার্কেটিং) চয়ন কুমার বলেন- খলিলুর রহমানের সকল রোগী আমাদের এখানে টেস্টের জন্য পাঠান। উনিও এসে বসে থাকেন। সে সময় রোগী আসলে এখানে বসেই দেখেন।

 

বিসিসির ৫নং ওয়ার্ড পলাশপুরের ভুক্তভোগী ইমরান পেদা জানান, তার গোপনীয় রোগ হয়েছিল। পরে তিনি চিকিৎসক খলিলুর রহমানের কাছে যান। এ সময় তাকে ভালো করার জন্য দামি দামি ঔষধ দেওয়া হয়।কিন্তু ভালো হওয়ার বদলে তার সমস্যা আরো বেড়ে যায়। পরে তিনি বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করান। চিকিৎসক তাকে বলেছেন ভুল চিকিৎসার কারণে তার এই অবস্থা হয়েছে। পরে পুরোপুরি সুস্থ হতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তার।

 

স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, আরএমপি কোর্স করেই পল্লী চিকিৎসকরা বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করছেন। এটি পুরোপুরি বন্ধ করা না হয় অথবা প্রেসক্রিপশনে তারা কি কি ঔষধ লিখতে পারবেন-এ ব্যাপারে যদি আইনগত কোনো নির্দেশনা থাকতো তবে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারতাম। এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। এর ফলে আমরা কাউকে আইনের হাতে সোপর্দ করতেও পারছি না।

 

প্রতিবেদক- ফাইজুল ইসলাম, সাহাদাত হোসেন, সালমান সানি, গোলাম রাব্বি।

আরও খবর

Sponsered content