অপরাধ

এই বাড়ির মালিক নার্সিং অধিদপ্তরের উন্নয়ন খাতের পিয়ন!

  প্রতিনিধি ২ নভেম্বর ২০২৩ , ৪:১১:১০ প্রিন্ট সংস্করণ

তালাশ ডেস্ক॥ ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. মহসীনের বিরুদ্ধে একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন থাকাসহ ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নার্সিং অধিদপ্তরের উন্নয়ন খাতের পিয়ন পদে চাকরি নিয়ে তিনি এখন রাজস্ব খাতের ড্রাইভার পদে কীভাবে বেতন নিচ্ছেন তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

জানা গেছে, তিনি এখানে চাকরি করে বিশাল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। বরিশালে পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পিছনে ৫ শতাংশ জমিতে নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল ৪ তলা বাড়ি। তার বাড়ির দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া হোটেল ব্যবসায়ী পরিচয়ে মিজানুর রহমান বাড়ির মালিকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

ইতিমধ্যেই তার বিরুদ্ধে গাড়ির জ্বালানি তেল নিয়ে ১৬ লাখ টাকার অনিয়মের তদন্ত শুরু হয়েছে। এ ছাড়াও নানা অনিয়মসহ অন্য আরেক জনকে অ্যাম্বুলেন্স চালাতে দিয়ে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থের বিষয়ে জানতে চেয়ে ২৫ অক্টোবর মো. মহসীনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ করেছে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক। স্বাস্থ্য বিভাগের উপর মহলে তার সখ্যতা থাকায় তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। তাই হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশ্ন শেষ পর্যন্ত তদন্ত কমিটি সঠিক রিপোর্ট দিতে পারবে কিনা। নাকি তত্ত্বাবধায়ককে ম্যানেজ করে তদন্ত চাপা দেওয়া হবে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ১০০ শয্যা বিশিষ্ট এই সদর হাসপাতালের সম্প্রতি ৭ মাসের বকেয়া তেল খরচে ১৬ লাখ টাকার ৩টি গাড়ির বিল ভাউচার দাখিল করে অ্যাম্বুলেন্স চালক মহসীন একাই। এই সূত্র ধরেই তার অনিয়ম ও দুর্নীতির থলের বিড়াল বেড়িয়ে আসে। বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিতে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। যা খতিয়ে দেখতে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শামীম আহমেদ গত ১১ অক্টোবর ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এতে গাইনি বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মো. মাহমুদ হাসানকে সভাপতি করা হয়। প্রথমে ৩ দিনের সময় দেওয়া হলেও কমিটি তদন্তের স্বার্থে সময় বাড়িয়ে নেন। ১১ অক্টোবর ১১৩২ নম্বর স্বারকে তদন্ত কমিটিকে দেওয়া চিঠিতে তত্ত্বাবধায়ক উল্লেখ করেন, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্সের তেলের বকেয়া বাবদ ১৬ লাখ টাকার অধিক বিল পরিশোধের জন্য পেট্রোল পাম্প মালিক থেকে বলা হয়েছে। কিন্তু তেল খরচের তুলনায় বিলের পরিমাণ বেশি বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই অ্যাম্বুলেন্সের মিটারের সঙ্গে তেল খরচের হিসাব ঠিক আছে কিনা তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

এদিকে তেল খরচের যথার্থতা নিরূপণ করে অনিয়ম আছে কিনা তদন্ত করে ৩ দিনের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট দিতে বলেন তত্ত্বাবধায়ক। তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে কমিটির ২ জন সদস্য কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে সঠিক তদন্তের স্বার্থে সময় বাড়ানো হয়েছে এবং কার্যক্রম চলমান আছে বলে তারা জানান।

এ অবস্থায় গত ২৫ অক্টোবর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ১১৯৫ নম্বর স্বারকে অ্যাম্বুলেন্স চালক মহসীনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। নোটিশে উল্লেখ করা হয়, অ্যাম্বুলেন্সের জ্বালানি গ্রহণ ও খরচ উপস্থাপন, নতুন অ্যাম্বুলেন্সটি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ এবং অপর অ্যাম্বুলেন্স চালক মো. শাহাদাৎ হোসেনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়ে অনিয়মগুলো নিম্নরূপ। যা হচ্ছে, জ্বালানি বকেয়া ১৬ লাখ টাকার অধিক বিল অত্যাধিক প্রতীয়মান হয়েছে। কারণ সেই তুলনায় গাড়ি চলেনি এবং মুভমেন্ট রেজিষ্ট্রটার ব্যবহার করা হয়নি। পাম্প কর্মচারীদের সঙ্গে আঁতাত প্রতীয়মান হয়। ইতিপূর্বে নতুন অ্যাম্বুলেন্সটি (ঢাকা মেট্রো ছ-৭১৩৩৪৮) বহিরাগত চালক দিয়ে চালিয়ে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ করা গুরুতর অনিয়ম। পাশাপাশি হাসপাতালের অপর অ্যাম্বুলেন্স চালককে গাড়ির দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা প্রতিপালন করেনি মো. মহসীন। এসব কারণ তত্ত্বাবধায়ক নোটিশে উল্লেখ করে চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী আইনত দণ্ডনীয় বলে উল্লেখ করেন।

এছাড়াও তদন্ত কমিটির কাছে বকেয়া বিলের সত্যতা ও হিসাব উপস্থাপনের জন্য বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে কেন আপনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে না; ৭ দিনের মধ্যে জবাব দিতে বলেছে তত্ত্বাবধায়ক।

এ ছাড়াও ১৯৮৫ এবং ২০১৮ নিয়োগ বিধি অনুযায়ী নার্সিং অধিদপ্তরের পিয়ন থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ড্রাইভার পদে মহসীনের নিয়োগ পাবার বিধান আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে করোনাকালীন সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রনোদণা বরাদ্দ এনে দিতে ১৫% উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রতি মাসে হাসপাতাল থেকে ভুয়া গর্ভবতী মায়েদের নাম ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর খাতায় উঠিয়ে মহসীন সরকারি তেলের বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাত করেন। অভিযোগ লগবইয়ে উল্লেখিত ভুয়া মোবাইল নম্বরে ফোন দিলেই বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল।

এছাড়া অভিযোগ আছে, ৪শ টাকা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার পরিবর্তে ১১শ টাকা ভাড়া আদায় করেন রোগীদের কাছ থেকে। তার চালিত অ্যাম্বুলেন্সে সরকারি লেখা থাকলেও তিনি সমগ্র বাংলাদেশ লিখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া জেলা ও বিভাগের বাইরে যান। রাতে তিনি ঝালকাঠির বাইরে রাত্রিযাপন করেন অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ড্রাইভার মহসীনকে চিঠি দিয়ে জানতে চান বলে সূত্র জানায়।

অভিযুক্ত অ্যাম্বুলেন্স চালক মহসীন বলেন, বরিশালের বাড়ি হাউজ বিল্ডিং লোন নিয়ে ২০২০-২১ সালে এবং আমাকে শোকজ করার জবাব দিয়েছি। আর তেলের হিসাবে গড়মিল হলে তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তদন্ত কমিটি আমার বক্তব্য নিয়ে তদন্ত করছে। এ ছাড়া আমাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার যে চিঠি দেওয়া হয়েছে অপর চালককে তা তিনি নেননি। কারণ তার চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় সে দায়িত্ব বুঝে নিতে চাচ্ছেন না। অবশ্য তিনি বলছেন, বৈধ প্রক্রিয়ায় তার রাজস্ব খাতের ড্রাইভার পদে নিয়োগ হয়েছে।

তেল হিসাবে ১৬ লাখ টাকার গড়মিল তদন্তের বিষয়ে কমিটির সভাপতি গাইনি কনসলটেন্ট ডা. মাহমুদ হাসান জানান, তদন্তের কাজ শেষ পর্যায়ে। এখন পেট্রল পাম্প মালিককে আমাদের সামনে এসে তার বক্তব্য উপস্থাপন করতে বলেছি। কিন্তু তিনি ব্যস্ততার কারণে আসতে না পারায় একটু দেরি হচ্ছে। খুব শিগগিরই রিপোর্ট দাখিল করা হবে।

ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. শামিম আহমেদ জানান, মহসীনের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু তাকে একাধিকবার সতর্ক করেও সংশোধন করা যাচ্ছে না। তদন্ত রিপোর্ট পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সূত্র- দৈনিক ইত্তেফাক

আরও খবর

Sponsered content