প্রতিনিধি ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ , ৯:১২:১৫ প্রিন্ট সংস্করণ
বেশিরভাগ ডায়াগনিষ্টিক সেন্টার ও বেসরকারী হাসপাতালই দালাল নির্ভর ॥ রোগী ও স্বজনদের পদে পদে ভোগান্তি
তালাশ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল নগরীতে ক্রমশই বেড়েই চলছে ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারের রোগীদের হয়রানী। দালাল নির্ভর, ভূল রিপোর্টসহ পদে পদে ভোগান্তিতে পরছেন রোগীরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই স্বাস্থ্যখাতে দূর্নিতীর বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও বরিশালে ডায়াগনিষ্টিক সেন্টার ও বেসরকারী হাসপাতালের অনিয়ম যেন থামছেই না! প্রিয় পাঠক বরিশাল নগরীর ডায়াগনিষ্টিক সেন্টার ও বেসরকারী হাসপাতালের অনিয়ম তদন্তে সরেজমিনে মাঠে মানে দৈনিক আজকের তালাশ অনুসন্ধান মাধ্যম। তদন্তে বেশ কয়েকটি ডায়াগনিষ্টিক সেন্টার ও বেসরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মেলে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর সদর রোড, গীর্জা মহল্লা মোড়, আগরপুর রোড, কাকলির মোড়, বাটারগলি, বিবির পুকুর পাড়, অশ্বিনী কুমার হল চত্বর, শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বরিশাল জেনারেল হাসপাতালের সামনে গেলেই চোখে পড়বে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য। নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজের বিনিময়ে রোগী ভাগিয়ে নেয়ার তুমুল প্রতিযোগিতা চলে দালালদের মধ্যে। দালালরা ওত পেতে থাকে নগরীর রুপাতলী, নথ্ল্লুাবাদ বাসটার্মিনাল ও লঞ্চ টার্মিনালে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা শহর থেকে উন্নত চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের জন্য। রোগীদের দালালরা তাদের পছন্দের ডাক্তার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। দালাল নির্মুলে বেশ কয়েকবার প্রশাসন অভিযান করলেও থেমে নেই দালালদের দৌরাত্ম।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার দিকে নগরীর সদর রোডের বাটার গলিতে অভিযান চালিয়ে ৮ জনকে আটক করে ডিবি পুলিশ। এরপর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিরুপম মজুমদার এ ৮ জনের প্রত্যেককে এক মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বরিশালে বেশির ভাগ চিকিৎসক প্রাইভেট প্রাকটিস করেন নগরীর সদর রোড এলাকায়। এ কারণে এ এলাকায় রয়েছে বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক। গ্রাম থেকে শহরে আসা রোগী ও স্বজনদের একটি চক্র বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল এলাকা থেকে ভুল বুঝিয়ে নিয়ে যায় নাম পরিচয়হীন চিকিৎসকদের কাছে। বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তাদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। এভাবে দিন দিন প্রতারিত হয়ে আসছিল গ্রাম থেকে শহরে চিকিৎসার জন্য আসা সহজ সরল মানুষেরা। তাদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতেই চালানো হয় এ অভিযান। এছাড়া শেবাচিম হাসপাতালেও বেশ কয়েকবার দালল নির্মুলে অভিযান পরিচালনা করেছে প্রশাসন। শুধু দালালদের দৌরাত্মই নয় ভুল রিপোর্ট দেয়া, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু সহ নানা অভিযোগ রয়েছে নগরীর বেশ কয়েকটি ডায়াগনিষ্টিক সেন্টার ও বেসরকারী হাসপাতালের বিরুদ্ধে।
চলিত বছরের শুরুতেই বরিশালে চিকিৎসকের অবহেলায় এক প্রসূতি নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ৬জানুয়ারী মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে নগরীর সদর রোডের অনামী লেনের বেঙ্গল হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এই ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেন মৃতের স্বজনরা। মৃতের নাম আন্নি আক্তার (২২)। সে নগরীর কাঠপট্টি এলাকার বাসিন্দা এবং বরিশাল সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী কর্মচারী সামিউল ইসলাম সিমান্তের স্ত্রী। মৃতের স্বজনরা জানায়, মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩ টায় আন্নিকে প্রসবজনিত সিজারিয়ান অপারেশনের জন্য ঐ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ডা. আফিয়া সুলতানার তত্ত্বাবধানে অপারেশনের মাধ্যমে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় সে। রোগী অপারেশন থিয়েটারে থাকতেই চিকিৎসকরা আন্নির স্বজনদের জানায় তার জরায়ুতে টিউমার রয়েছে, দ্রুত সেটি অপারেশন করা প্রয়োজন। রোগীর শারীরিক অবস্থা ভালো থাকার শর্তে টিউমার অপারেশনের অনুমতি দেন স্বজনরা। তার শরীরে অবস্থা ভালো জানিয়ে টিউমার অপারেশনের কথা বলেন চিকিৎসকরা। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে চিকিৎসকরা তাদের জানায়, রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন। দ্রুত তাকে শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তারা। সেখানে নেওয়া হলে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক স্বজনদের জানায়, অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্বজনরা আন্নির লাশ ফের বেঙ্গল হাসপাতালে নিয়ে যায়। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে হাসপাতালের চিকিৎসকসহ দায়িত্বরতরা পালিয়ে যায়।
গত বছরের আগষ্ট মাসে চিকিৎসা অবহেলায় বরিশাল নগরীর বেলবিউ হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আরেক গর্ভবতী নারীর মৃত্যু হয়েছে। ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার শুক্তঘর গ্রামের বাসিন্দা শাহানাজ পারভীন (৪০) নামে ওই নারী সদর রোডস্থ বিবির পুকুরের পশ্চিম পাশের হাসপাতালটিতে সন্ধ্যা রাতে অপারেশন থিয়েটারে প্রাণ হারালে শুরু হয় উত্তেজনা। এই বিয়োগান্তের ঘটনায় কর্তৃপক্ষ তাদের দায় অস্বীকার করলেও রোগীর স্বজনরা সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের গাইনী চিকিৎসক জি.কে চক্রবর্তী এবং মেডিকেল অফিসার কাজী আহম্মদউল্লাহকেই দায়ী করছে। এর আগে একই বছরের জুলাই মাসের শেষ দিকে শহরের ব্রাউন কম্পাউন্ড রোড এলাকার রয়েল সিটি হসপিটালে এক তরুণী অনুরূপভাবে চিকিৎসা অবহেলায় প্রাণ হারায়। এ বিষয়টি থানা পুলিশ হয়ে শেষ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে ঠেকেছে। জানা গেছে, ওই আলোচিত মামলার আসামি চার চিকিৎসকসহ অন্তত ৭ জন প্রকাশ্যে ঘুরছে। এছাড়া একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে বরিশালের বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মীর দারস্থ হতে দেখা গেছে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আফরোজকে।
এছাড়া মৃত চিকিৎসকের স্বাক্ষর ব্যবহার করে প্যাথলজি রিপোর্ট তৈরি করায় বরিশালের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা ও দুই মালিককে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। করোনার মহামারীর প্রথম ধাপের মধ্যে নগরীর জর্ডান রোড এলাকার ‘দি সেন্ট্রাল মেডিকেল সার্ভিসেস’ নামের ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এ অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও বরিশাল জেলা প্রশাসনের তৎকালীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াউর রহমান জানান। দণ্ডিতরা হলেন- সেন্ট্রাল মেডিকেল সার্ভিসেসের মালিক জসিম উদ্দিন মিলন, এ কে চৌধুরী কাফি ও চিকিৎসক নূর এ সরোয়ার সৈকত। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া চিকিৎসক এমদাদুল্লাহ খানের নামও ডায়াগস্টিক সেন্টারের সাইনবোর্ডে ব্যবহার করা হয়েছে। জানা যায়, স্থানীয় একটি পত্রিকার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ওই ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারটিতে রোগীদের নানা ভাবে হয়নারী করে আসছিলো ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারের মালিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ডাক্তারের জাল স্বাক্ষরে রিপোর্ট তৈরিসহ প্রতারণার নানা অভিযোগে নগরীর আগরপুর রোডে দি মুন মেডিকেল সার্ভিসেস নামক একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে সিলগালা করা হয়েছে। এর দুই মালিককে ছয় মাস ও দুই কর্মচারীকে তিন মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রমমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালায় বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা। এসময় একজন ডাক্তার ও টেকনোলজিস্টের জাল স্বাক্ষর করে রোগীদের প্যাথলজি রিপোর্ট দেয়া হচ্ছিলো। এছাড়া প্যাথলজি রিপোর্ট তৈরিকালে মেয়াদোত্তীর্ণ রি এজেন্ট ব্যবহারের প্রমাণ পায় পুলিশ। ২০১৭ সালে লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হলেও করা হয়নি নবায়ন। এসব অভিযোগ প্রমাণে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ৪ জনকে আটক করে পুলিশ। এর মধ্যে মালিক মো: হোসেন শাহিন ও শ্যামল মজুমদারকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং তাদের কর্মচারী ইব্রাহিম রানা এবং শ্যাম সাহাকে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন ভ্রমমাণ আদালত। আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারটিকে সিলগালা করে দেয়া হয়। ওই ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারেও রোগী ও রোগীর স্বজনদের নানা হয়রানী করার অভিযোগ রয়েছে। এক বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারের ঝাড়ুদার থেকে রাতারাতি মালিক বনে যায় শাহিন। এছাড়া শাহিন নিজের অপকর্ম আড়াল করতে বরিশালের স্থানীয় একটি পত্রিকা লিজ নিয়ে বেশ কয়েকদিন দৌঁড়ঝাপ করেছেন।
নগরীর চাঁদমারী ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে রোগীর বাম পাশে হার্নিয়া, অপারেশনের কথা বাম পাশে। কিন্তু চিকিৎসক অপারেশন করেছেন ডান পাশে। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল বরিশালে। ভুক্তভোগী রোগীর নাম মো. মানিক (৪৪)। তিনি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া এলাকার বাসিন্দা এবং ঢাকায় একটি ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠানে মেকানিক্যাল ফিডার হিসেবে কর্মরত। রোগের সমস্যার সমাধান না করে রবিবার সন্ধ্যায় ওই রোগীকে ছাড়পত্র দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মো. মানিক জানান, হার্নিয়ার সমস্যা নিয়ে গত ২২ নভেম্বর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ সার্জন ডা. এমএস রহমান সুমনকে দেখান তিনি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডা. এমএস রহমান সুমন ওই রোগীকে জানান তার বাম পাশে হার্নিয়া হয়েছে। ব্যবস্থাপত্রেও তিনি তার বাম পাশে হার্নিয়ার কথা উল্লেখ করেন। অফিসের ছুটি না থাকায় ওই সময় অপারেশন করতে পারেননি তিনি। পরে ছুটি নিয়ে গত ১৭ ডিসেম্বর চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. এমএস রহমান সুমনের তত্ত্বাবধানে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি হন। ওইদিন সন্ধ্যায় বিশেষজ্ঞ সার্জন ডা. এমএস রহমান সুমন তার হার্নিয়া অপারেশন করেন। পরদিন ১৮ ডিসেম্বর সকালে জ্ঞান ফেরার পর তিনি বুঝতে পারেন তার পুরুষাঙ্গের ডান পাশে অপারেশন করা হয়েছে। অথচ অপারেশন করার কথা ছিল বাম পাশে। এ নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বললে তারা অপারেশন সংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র নিয়ে যান এবং অপারেশনের বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য অনুরোধ করেন।
এদিকে রোগী হয়রানির অভিযোগ রয়েছে ল্যাবএইড ডায়াগনস্টিক বরিশাল শাখার বিরুদ্ধে। সূত্রে জানা যায়, বরিশাল নগরীর ১০৬ নং সদর রোডের ল্যাবএইড শাখায় যান সদর উপজেলার চরবাড়িয়া নিবাসী মিসেস্ বিউটি (ছদ্দ নাম)। সকাল ১০ টা ৩০ মিনিটে রিসিপশনে কথা হয় দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তার সাথে। রোগির সাথে ঢাকা থেকে আগত হোমিওপ্যাথি একজন চিকিৎসকের সাদা একটি কাগজে লেখা টঝএ ৪উ প্রদর্শন করা হলে রিসিপশনে বসা সেই কর্মকর্তা ডায়াগনস্টিকের নির্ধারিত ডেস্ক টেলিফোন থেকে একজনকে ফোন করে কথা বলেন। পরবর্তীতে রোগিকে জানানো হয়, টেস্ট করাতে হলে ১৫০০ টাকা বিল প্রেমেন্ট করতে হবে। টাকা জমা দেয়ার পরে তারা জানান ৩ তলায় একটি কাগজ জমা দিতে হবে যার বিল নং বি ২০১২২৮২১৯৬, তারিখ ১৩-১২-২০, কোড ০৭৮২, টেস্ট নাম ইউএসজি অফ ফোর ডি ডেলিভারি সময় ১৩-১২-২০, সন্ধা ৬ ঘটিকা। দুপুর ১২ টার পরে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হবে। এসময় রোগির খালিপেটে থাকতে কষ্ট হয় জানালে দায়িত্বরত কর্মকর্তা বলেন, বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটের ভিতরে আপনার টেস্ট করানো হবে। তার কথা মতো বিকেল ৫ টায় রোগী আসলে উপস্থিত একজন মহিলা কর্মকর্তা বলেন, ডক্টর মেডাম ৬টা৩০ মিনিটে আসবে অপেক্ষা করেন। ৬ টা ২০ মিনিটে মহিলা কর্মকর্তা বলেন, আপনার সিরিয়াল ১০, ৩০১ নং রুমের সামনে অপেক্ষা করেন। অপেক্ষার এক পর্যায় মহিলা কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেন আমিতো প্রথম কাগজ জমা দিয়েছি তাহলে সিরিয়াল ১০ কেনো তিনি বলেন ভুল হয়েছে আমি এখনি দেখছি বলে তিনি ডক্টরের রুমে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষন পরে বের হয়ে বলেন আপনার টেস্ট করানো সম্ভব নয় ডক্টর মেডাম টেস্ট করবে না। এসময় কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন ডক্টরের প্যাডে লিখে আনতে হবে। মহিলা কর্মকর্তা পুনরায় ডায়াগনষ্টিকের নির্ধারিত ডেস্ক টেলিফোন থেকে ফোন করে সকালের টাকা জমা নেয়া কর্মকর্তার খোঁজ করে, টেলিফোনে তাকে না পেয়ে অপরপাশে থাকা ব্যক্তিকে বলেন, “আপনারা কিছু জানেন না এর আগে বহুতবার আপনাদের বলেছি না বুঝে কোনো টেস্ট এলাও করবে না। এতে রোগীদের হয়রানি হয় বলে ফোন রেখে দেন।” তাদের হয়রানিকে ধামাচাপা দিতে তাৎক্ষণিক মানি রিসিভে লিখে দেন ঘঙঞ উঙঘঊ” রোগির সমস্যার কারনে কাগজটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, টপ ফ্লোরে চলে যান। সেখানে যাওয়ার পর অবস্থানরত কর্মকর্তা বলেন স্যার আসছে বসেন। তার কিছুক্ষন পরে একজন উপস্থিত হয়ে বলেন ভিতরে আসেন এবং টাকা ফেরতের কারন জানতে চান। তাকে এরকম হয়রানির কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ফোন করে দিচ্ছি কেনো হবেনা অবশ্যই করে দিবো। এমন আশ্বাসের পরেও পুনরায় রিসিফশন থেকে বলেন ম্যাডাম টেস্ট করবেনা। তার কিছুক্ষন পরে ল্যাব এইড বরিশালের এজিএম এন্ড ইনচার্জ মো: আব্দুল জলিল সিকদারের ছিল ও স্বাক্ষর সম্বলিত একটি রিসিভ দিয়ে বলেন, কাউন্টারে জমা দিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে যান। রোগীর স্বজনরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “যদি টেস্ট নাই হবে তবে কেনো আমার মাকে এতো কষ্ট দিলো তারা। সকালেই বলে দিতো টেস্ট হবেনা। আমার মনে হয় কোনো রকম যোগ্যতা ছাড়াই এদেরকে নিয়োগ দিয়ে আমাদের মতো সাধারন মানুষের সাথে প্রতারনা করছে। ল্যাবএইড বরিশালের এজিএম এন্ড ইনচার্জ মো: আব্দুল জলিল সিকদার দৈনিক আজকের তালাশকে মুঠোফোনে বলেন,“রোগির সাথে যে বিষয়টি হয়েছে সেটি আসলেই হয়রানী, তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা রোগীর স্বজনদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছি।” তবে এ ঘটনায় তিনি কোন সদোত্তর দিতে পারেনি।
টেষ্টের রিপোর্ট নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে শাপলা ডিজিটাল ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধেও। এ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন এক রোগী। অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বরিশাল সদর উপজেলার রাড়িমহল এলাকার বাসিন্দা মিসেস্ রাসিদা। তিনি জরায়ু সমস্যা নিয়ে গত ১৫ ডিসেম্বর ডাঃ সিনিগ্ধা চক্রবর্তী কাছে চিকিৎসার জন্য যান। ওই চিকিৎসক মিসেস্ রাসিদাকে একটি টিভিএস টেষ্ট দেয়। পরে দালালদের খপ্পরে পড়ে রোগীর স্বজনরা শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে শাপলা ডিজিটাল ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারে টেষ্টটি করাতে যায়। সেখান থেকে টিভিএস টেষ্টের রিপোর্ট নেগেটিভ দেয়া হয়। পরে ওই রোগী সেই রিপোর্ট দেখাতে ডাঃ সিনিগ্ধা চক্রবর্তী কাছে যায়, রিপোর্ট সন্দেহজনক হলে চিকিৎসক পুনরায় রিপোর্ট করাতে বলেন। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর স্বজনরা ১৬ ডিসেম্বর মেডিনোভায় টেষ্টটি পুনরায় করান। সেই রিপোর্টে ওই রোগীর জরায়ুতে সমস্যা রয়েছে বলে জানায় চিকিৎসক। দুই ধরনে রিপোর্ট নিয়ে বিপাকে পড়ে রোগী ও তার স্বজনরা। পরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ডাঃ ফরিদা বেগমের স্বরনাপন্ন হয় রোগী ও তার স্বজনরা। ডাঃ ফরিদা পারভিন মেডিনোভার রিপোর্ট অনুযায়ী মিসেস্ রাসিদাকে অপারেশনের পরামর্শ দেয়। গত শনিবার ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ওই রোগীর সফলভাবে অপারেশন সম্পন্ন হয়। রোগী মিসেস্ রাসিদার ভাই সুরুজ জানায়,‘আমার বোনের সমস্যা নিয়ে প্রথমে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ডাক্তার দেখাই। সেখানের ডাক্তার একটি টিভিএস টেষ্ট দেয়। মেডিকেলের সামনের দালালদের খপ্পরে পরে আমি আমার বোনকে নিয়ে শাপলা ডিজিটাল ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারে যাই। সেখানে রিপোর্ট দেখে ডাক্তারের সন্দেহ হয় এবং তিনি আবারও রিপোর্ট করাতে বলেন, পরে আমরা একই রিপোর্ট মেডিনোভায় করাই। সেই রিপোর্টে আমার বোনের সমস্যা ধরা পড়ে। দুই জায়গার দুই রিপোর্ট নিয়ে আমরা পড়ি মহাবিপদের মধ্যে। পরে আমরা আবারও আরেক ডাক্তার দেখাই। সেখানের ডাক্তার মেডিনোভার রিপোর্ট সঠিক বলে অপারেশনের পরামর্শ দেয়।’ সুরুজ আরও জানায়, ‘অপারেশন সম্পন্ন হওয়ার পরে আমি শাপলা ডিজিটাল ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারে যোগাযোগ করি। সেখানে ভুল রিপোর্ট দেয়ার জন্য আমরা টাকা ফেরত চাই, রিসিফশন থেকে আমাদের বলা হয় পরে যোগাযোগ করা হবে। আমি ২২ডিসেম্বর শাপলা ডিজিটাল ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারের অফিসিয়াল নাম্বার যোগাযোগ করলে তারা জানায়-আপনাদের টাকা ফেরত দেয়া হবে না। পরে আমি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কথা জানালে শাপলা ডিজিটাল ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারের কর্তব্যরত ওই নারী কর্মকর্তা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে হুমকি দিয়ে ফোনটা কেটে দেয়। এভাবে সাধারন মানুষের রোগকে পুঁজি করে প্রতারনা করার অর্থ আমি বুঝলাম না, সেবার নামে এসব প্রতারণাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই আমি।’ এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে অভিযোগ দায়ের করা হবে বলেও জানায় মিসেস্ রাসিদার ভাই সুরুজ। এব্যাপারে শাপলা ডিজিটাল ডায়াগনিষ্টিক সেন্টারে পরিচালক মো. শাহিন খান দৈনিক আজকের তালাশকে বলেন,‘আমাদের মেশিন বরিশালের মধ্যে অন্যতম একটি মেশিন এখানের রিপোর্ট ভুল হওয়ার কথাই না, তারপরেও আমরা ওই রোগীকে ডেকেছি কিন্তু তিনি আসেনি।’ রোগীর স্বজনদের বরাত দিয়ে অপারেশনের পরে হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার কারনে রোগী যেতে পারেনি বলে জানালে শাহিন খান তাদের রিপোর্ট সঠিক বলে দাবী করেন।
উল্লেখ্য, বরিশাল নগরীতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাব। এদের বেশির ভাগেরই যথাযথ অনুমোদন নেই। স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো সঠিক তথ্যও নেই। কোনো তদারকিও নেই। প্রশিক্ষিত টেকনোলজিস্ট-টেকনিশিয়ান এবং রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তার ছাড়াই পরীক্ষা-নিরীক্ষার রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার, আয়া, বুয়ারা কমিশনের মাধ্যমে এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠান। এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা এবং চিকিৎসার নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে নগদ টাকা। প্রিয় পাঠক বরিশাল নগরীর অনুমোদনবিহীন ডায়াগনিষ্টিক সেন্টার ও বেসরকারী হাসপাতালের নানা অনিয়ম নিয়ে পরবর্তী প্রতিবেদন দেখতে চোখ রাখুন দৈনিক আজকের তালাশ পত্রিকার পাতায়।